গোলাঘর : বীজ সংরক্ষণের লোকজ রীতি

:: বারসিক ফিচার ডেস্ক ::

কৃষিপণ্যের বাজার নির্ভরতায় গোলাঘরে বীজ সংরক্ষণের চর্চা বর্তমানে ক্রমশ কমলেও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কিছু কৃষক পরিবার এখনও লালন করছেন বীজ সংরক্ষণের সেই রীতি। এখানকার কৃষকরা আজও আঙিনার গোলাঘরে নিজস্ব কায়দায় সংরক্ষণ করেন নিজেদের উৎপাদিত শস্যফসলের বীজ। লোকজ এই চর্চার মধ্য দিয়েই তারা সমুন্নত রেখেছেন বীজ সম্পদে আপন  অধিকার।

দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এই এলাকার কৃষকের বীজফসল সংরক্ষণের গোলাঘরগুলো নির্মাণ শৈলীতে যেমন পৃথক তেমনি এই গোলাঘরে বীজ সংরক্ষণের কৌশলটিও স্বতন্ত্র। মাটি থেকে পানি চুইয়ে গোলাঘরের আর্দ্রতা যেন না বেড়ে যায় বা পোকা মাকড়ের আক্রমণ কমানোর জন্য ভূমি থেকে ১ দেড় ফুট উঁচুতে ৬-৮টি পিলার আকৃতির গোল মোটা কাঠ বা গাছের গুড়ির উপর পাটাতন বানিয়ে তার উপর তৈরি করা হয় এই গোলাঘর। আড়াআড়ি কয়েকটি কাঠের তক্তা পেতে বাঁশের ছাঁচ বা কুচনি দিয়ে গোলাঘরের পাটাতন তৈরি করা হয়। পাটাতনের নিচ থেকে বাতাস ঢুকে যাতে গোলাঘরের সংরক্ষিত শস্যদানা নষ্ট করে না দেয় এজন্য গোবর ও ধানের তুষ মিশিয়ে পাটাতনের মেঝেতে প্রলেপ দেওয়া হয়। কখনো কখনো গাব ফলের নির্যাস দিয়েও পাটাতন লেপে দেওয়া হয়। এতে বাতাস প্রতিরোধের পাশাপাশি পাটাতন শক্ত ও মজবুত হয়। এবার পাটতনের ওপর বাঁশের চাটাই দিয়ে গোলাকৃতির গোলাঘরের বেড়া তৈরি করা হয়। গৃহস্থরা যাকে স্থানীয় ভাষায় বলেন ‘কাতার’। গোলাঘরের চালের ছাউনি হিসাবে ব্যবহৃত হয় খড়ের নাড়া বা গোলপাতা। ছাউনির শীর্ষে একটি মাটির পাত্র এমনভাবে স্থাপন করা হয় যা ঝড় বা বাতাসে গোলাঘরে ছাউনি উড়ে যেতে বাধা দেয়। এক একটি গোলাঘর সাধারণত ৮-৯ ফুট উঁচু হয় যার পাদদেশের দৈর্ঘ্য থাকে মোটামুটি ৮-১০ ফুট আর ব্যাস রাখা হয় প্রায় ৯-১২ ফুট।

শ্যামনগরের কৃষকগণ তাদের গোলাঘরের বীজ সংরক্ষণের জন্য অনুসরণ করেন বিশেষ রীতি। সারাবছরের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত ধান গোলায় উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা হয় আর বীজ ধান রাখা হয় সযন্তে বস্তায় ভরে। গোলা ঘরের নিচের পাটাতনের ফাঁকা জায়গায় তারা সংরক্ষণ করেন ওল, মুখিকচু ও হলুদসহ নানাধরনের কন্দাল ফসল বীজ। গোলায় সংরক্ষিত ফসল বীজ মাঝে মধ্যে বের করে রোদে শুকাতে হয়। গোলাঘরে রাখা বীজের মানের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না বলে জানালেন চন্ডীপুর গ্রামের কৃষক সন্তোষ কুমার মন্ডল। তিনি বলেন, ‘গোলাঘরে ধান বীজ রাখলে বীজ ভালো থাকে। তাছাড়া শোবার ঘরে ধান রাখলে ইদুরের উপদ্রব বাড়ে আর ইদুর বেশি হলে সাপের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে’।

গোলাঘরে বীজ সংরক্ষণের সাথে জড়িয়ে আছে এখানকার কৃষকের কতিপয় ধারণা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি। এই বিশ্বাস থেকেই চন্ডীপুর গ্রামের হিন্দু ধর্মের অনুসারীগণ ধানবীজ বপন, চারা রোপণ, শস্যকর্তন ও গোলাজাতকরণের সময় গোলাকে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে আয়োজন করেন পুজা, পালন করেন নানা আচার-অনুষ্ঠান। সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেন গোলাঘরে ঝাড়ু স্পর্শ। এমনকি গোলাঘরে প্রবেশের সময় শারীরিক পবিত্রতাও বজায় রাখা হয়। গোলাঘর শুধু ফসল সংরক্ষণের স্থানই নয় বরং সমাজে মানুষের অবস্থান, সম্মান ও প্রতিপত্তিও নির্দেশ করে এই গোলাঘর। আঙিনায় একাধিক গোলাঘর সমাজে গৃহস্থের আর্থিক স্বচ্ছলতা প্রকাশ করে। সে কারণে একসময় এই এলাকার অবস্থাপন্ন কৃষকরা উঁচু করে গোলাঘর তৈরি করতেন যাতে দূর থেকে তা দৃশ্যমান হয়।

গোলাঘরে বীজ ফসল সংরক্ষণ ও গোলাঘর কেন্দ্রিক নানা আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস নিঃসন্দেহে এ এলাকার কৃষি সংস্কৃতিরই অংশ যা চর্চার মধ্য দিয়েই টিকে থাকতে পারে বীজ সম্পদের উপর কৃষকের অধিকার।

happy wheels 2

Comments