পাহাড়ি ছড়া ও ঝর্ণা: আদিবাসীদের সুপেয় পানির অন্যতম উৎস
কলমাকান্দা থেকে গুঞ্জন রেমা ::
কলমাকান্দা উপজেলা থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে বনবেড়া ও কচুগড়া গ্রাম অবস্থিত। এই গ্রামগুলোতে বাস করেন গারো ও হাজং আদিবাসী, গ্রামে তারই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি পাহাড়ি ছড়া যার উৎপত্তিস্থল ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র, ’নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ এর মতো অবস্থা। অনেকে আবার পাহাড় থেকে লাকরি (জ্বালানি) এনে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। দারিদ্রতা এবং অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার কারণে উক্ত গ্রামগুলোর মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। উপরোন্তু সুপেয় পানির সঙ্কট তাদের জীবন ও জীবিকার সমস্যাগুলো আরও প্রকট করে তুলেছে।
এত সমস্যা মাঝেও থেমে নেই ওই গ্রামগুলোর মানুষের পথচলা! নিজের মতো করে তারা পানি সঙ্কট মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন উপায় বের করেছেন। আদিবাসীরা প্রকৃতি থেকেই তাদের জীবন-জীবিকার বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করেন। প্রকৃতির সাথে রয়েছে তাদের নিবিড় সম্পর্ক। প্রকৃতির বন, গাছ, ফলমূল, পশু, পাখি, ছড়া, ঝর্ণা ইত্যাদির তাদের জীবন-জীবিকার প্রধান উপাদান। তাই তো সুপেয় পানি সমস্যা সমাধানে তারা প্রকৃতি থেকেই উপায় বের করেছেন। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসের কারণে তারা অসংখ্য ছড়া ও পাহাড়ি ঝর্ণার অস্তিত্ব পেয়েছেন। এসব ছড়া ও ঝর্ণার পানি, স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ। ঝর্ণার পানি সংগ্রহ করে তারা তাদের পারিবারিক ব্যবহার ও সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করেছেন। তাই পানি সঙ্কট মোকাবিলায় তারা পাহাড়ি ঝর্ণার পানি সংরক্ষণ করেছেন। পানির এই উৎসকে পরিচর্যা করছেন। নানান অবকাঠামো নির্মাণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে প্রাকৃতিক বিভিন্ন পানি ও খাদ্যের উৎস যখন ধীরে ধীরে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে সেখানে এই আদিবাসীরা তাদের নিজের প্রয়োজনে এসব প্রাকৃতিক উৎস রক্ষা করেছেন, পরিচর্যা করছেন, প্রকৃতিতে ভারসাম্য রক্ষায় চেষ্টা চালিয়েছেন নিরন্তর।
সুপেয় পানি সমস্যা মোকাবিলা করার প্রসঙ্গে এলিয় ঘাগ্রা বলেন, “ছড়ার ধারে একটি পাহাড়ি ঝর্ণা আছে সেখান থেকেই আমরা সারাবছর পানি পান করি।” ঝর্ণার পানির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাহা হাজং বলেন, “টিউবওয়েলের পানিতে গন্ধ থাকে, আয়রন থাকে কিন্তু এ ঝর্ণার পানিতে কোন প্রকার আয়রন বা গন্ধ নেই।” কতটি পরিবার এ ঝর্ণার পানি পান করে জানতে চাইলে সিমসন রিছিল বলেন, “আমাদের দুই গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ২৯টি পরিবারের ১২০ জন মানুষ এ ঝর্ণার পানি পান করে।” তবে পাহাড়ি ঢল আসলে ঝর্ণার পানি সংগ্রহে কিছুটা সমস্যা হয় ওই গ্রামের আদিবাসীদের। এই প্রসঙ্গে সারথী হাজং বলেন, “উজান থেকে যখন পাহাড়ি ঢল আসে তখন তারা কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা সমস্যায় পড়ি। তবে পাহাড়ি ঢল বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয় না বলে আমরা দ্রুতই সমস্যা কাটিয়ে উঠি।”
অন্যদিকে ঝর্ণার পানি ব্যবহারে কিছু সমস্যা বা অসুবিধার কথা জনান ওই গ্রামবাসীরা; সেটা মূলত সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং অবস্থানগত কারণে। এই প্রসঙ্গে আর্দিস হাজং বলেন, “এই ঝর্ণা একদিকে যেমন খোলামেলা স্থানে আর অন্যদিকে ছড়ার মধ্যে অবস্থিত। ফলশ্রুতিতে অনেকসময় গরু, ছাগল পানি খেতে এসে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে পানি দূষিত করে। আবার উজানে অনেকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় ওই বিষ পানির সাথে মিশে আসে এই ছড়া দিয়ে, যা ঝর্ণার পানিকে দূষিত করে। এছাড়াও অনেকে নানা জেনে না বুঝে এসব ঝর্ণা বা ছড়ার পানিকে দূষিত করে।” ওই গ্রামের আদিবাসীরা মনে করেন, প্রাকৃতিক এ ঝর্ণা ও ছড়াগুলোকে যদি রক্ষা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে এগুলো একদিকে যেমন বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাবে অন্যদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সৌদর্য বৃদ্ধি করবে। তারা মনে করেন মানুষের প্রয়োজনেই এসব প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা উচিত।
উল্লেখ্য যে, ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে পাহাড় ঘেঁষা বনবেড়া ও কচুগড়া গ্রামগুলোতে গভীর নলকুপ বসানো কঠিন। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যে ক’টি টিউবওয়েল বসানো হয়েছে সেগুলোতে বিশুদ্ধ পানি উঠে না; বিশুদ্ধ করার জন্য উঠানো পানিকে ফিল্টারিং করতে হয়। কারণ পানিতে এক ধরনের দুর্গন্ধ ও আয়রণ থাকায় সেটা পানযোগ্য নয়।