মগড়া মরুক!
:: রনি খান, নেত্রকোনা থেকে
নদী আবহমানকাল ধরে মানুষের আশ্রয়। নদী শুধু একটি নদী নয়। একটি নদী একটি জনপদ, একটি সভ্যতা, একটি ইতিহাস। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে খুব স্বাভাবিকভাবেই সভ্যতার নামের সাথে জড়িয়ে আছে, নদীর নামটিও। ক্ষেত্রবিশেষে নদীর নামেই গড়ে উঠেছে সভ্যতা, স্থাপত্য সাম্রাজ্য। নদীর গতিপথ, নদীর চরিত্র আর নদীর মানচিত্রই একসময় হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্য স্থাপনের, সাম্রাজ্য চিহ্নায়নের, সাম্রাজ্য পরিচালনার মূল সূত্র।
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। ‘নদীমাতৃক’ শব্দটিতে যথার্থরূপে জানান দেয় যে, নদী বাংলাদেশের মায়ের মতো। বাংলাদেশের মানচিত্রে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে অজস্র নদী, উপনদী। যেগুলো মাতৃজঠরের নাড়ীর মতো ধরে রয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের সব বড়ো বড়ো শহর-বন্দর-বাজার-হাট গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। তাই একথা বললে মোটেই অত্যুক্তি করা হবে না যে, বাংলাদেশ আমাদের মা, আর নদী বাংলাদেশের মা।
‘মগড়া’ বাংলাদেশের অজস্র মৃতপ্রায় নদীগুলোর একটি। ‘মগড়া’ নামের আভিধানিক অর্থ উত্তাল। বলাইবাহুল্য যখন মগড়া’র নামকরণ করা হয়েছিলো তখন মগড়া ছিলো দুর্দান্ত যৌবনে, মানুষের কাছে ছিলো আতঙ্ক। কিন্তু কালের করাল গ্রাসে আর মানুষের আপোষহীন ভূমিকায় এখন নদীটি’র মতোই ‘মগড়া’ নামটিও নিয়েছে ভিন্ন অর্থ। এখন মগড়া মানেই যেনো- নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ, ধুকে-ধুকে মরা।
কিন্তু প্রাকৃতিক সত্য হচ্ছে একটি নদী কখনো মরে না বা মরতে পারে না। কারণ এই নদীর উপরই ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে একটি জনপদ, সে জনপদের মানুষ, পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য।
মগড়া নদীটির দৈর্ঘ্য ৮৫ কি.মি.। এর উৎপত্তি পূর্বধলার ধলাইখাল থেকে এবং সমাপ্তি ধনু নদীতে এবং সমাপ্তি ধনী নদীতে। ১৪৩টি গ্রাম এর পাড়ে গড়ে উঠেছে। ১৪৩ টি গ্রামের কেন্দ্রবিন্দু এই মগড়া নদী। সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠভূমি নেত্রকোনা শহরটিও গড়ে উঠেছে মগড়াকে কেন্দ্র করে। বর্তমানের নেত্রকোনা মডেল থানাটি ‘নাটেরকোনা’ নামক স্থান থেকে বর্তমান জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে এই মগড়ার জন্যই। মগড়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নেত্রকোনা শহরের ব্যাবসা-বাণিজ্য-অফিস-আদালত-সাহিত্য-সংস্কৃতি।
নেত্রকোনা শহরে পুরাতন কোর্ট, হাসপাতাল, জেলখানা, জেলার প্রাচীন স্কুল চন্দ্রনাথ স্কুলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো মগড়া তীরবর্তী। নেত্রকোনার পাটপট্টি, মেছুয়া বাজার, ব্যাংক, ধানমহাল প্রায় সবগুলো স্থাপনাই নদী নির্ভর বা নদীকেন্দ্রিক। এই বিষয়গুলো আমাদেরকে মগড়ার অস্তিত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
মগড়া পাড়ের বিভিন্ন পেশার মানুষ, তাদের খাদ্যাভ্যাস, তাদের সংস্কৃতি সঙ্গত কারণেই নদী নির্ভর। নেত্রকোনার সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও রয়েছে এর ছাপ। কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে মগড়ার আকৃতিগত কারণেই নেত্রকোনা শহরটির নাম ‘নেত্রকোনা’ হয়েছে। ‘নেত্র’ মানে চোখ। মগড়া’র আকৃতির কারণে যেহেতু নেত্রকোনাকে চোখের কোনার মতো মনে হয় সেহেতু এর নাম নেত্রকোনা। যাহোক এক কথায় বলা চলে বাংলাদেশের অজস্র নদী এবং শহরের সম্পর্কের মতোই মগড়া নেত্রকোনা’র মা।
কিন্তু মায়ের নাড়ী ছেড়া ধন যেমন মায়েরই শরীরের অংশভক্ষণে পুষ্ট হয়ে এক সময় পরিত্যাগ করে মাকে, আমরাও যেনো সেই রকম সন্তান। নিস্তেজ, নিরীহ, স্রোতহীন মগড়া কি আমাদের সেই কথাই বলে না। মগড়ার উপর অপরিকল্পিত স্থাপনাগুলো অবশেষে আমাদের নিজেদের জন্যই হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যেথায় ইচ্ছা বাঁধ দিয়ে, দখল করে, ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করে, আমাদের অস্তিত্বকেই বিনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছে না কি? মগড়া না থাকলে জীববৈচিত্র্য থাকবে না, পেশাবৈচিত্র্য থাকবে না। আমি কোনো পরিসংখ্যানগত তথ্যের দিকে না গিয়েও বলছি আমরা হারাবো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি।
মায়ের কাছে মায়ের মতো ফিরবো কি ফিরবো না তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, মগড়াকে বাঁচাবো কি বাঁচাবো না তাও গুরুত্বপুর্ণ নয়। বরং আমাদের ভাবতে হবে আমরা নিজেরা টিকবো কি না?