আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ-২০১৫
:: ঢাকা থেকে এবিএম তৌহিদুল আলম
কবির ভাষায় ‘যার বুকে তুই জনম নিলি, তারে চিনলি না’/ মাটির মঙ্গল করো রে ভাই, মাটি যে তোর মা’। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সকল চিহ্ন আর নিদর্শন ধারণ করে আছে মাটি। খাদ্য উৎপাদন থেকে বহুতল ভবন নির্মাণ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের আবাসস্থল থেকে সুবিশাল মহীরূহ, পানি পরিশোধন থেকে জলবায়ু সুরক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণে মাটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জীবকুলের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের যোগান দিয়ে যাচ্ছে যে মাটি; তার উপর দাঁড়িয়ে কখনো কি ভেবে দেখেছি, সে কেমন আছে? ভেবেছি কি, মাটি না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব কী থাকতো? হয়তো এ রকম উপলব্ধি থেকেই জীবন রক্ষার এই বহুমুখী অনন্য উপাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ সভায় ২০১৫ সালকে আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ (An International year of soil-2015) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণার প্রতিপাদ্য হলো ‘সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যবান মাটি’ (Healthy soils for healthy life) । ‘আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ-২০১৫’ উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানো, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নে মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব তুলে ধরা। মৃত্তিকা সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন’ (এফএও) এবং ‘সয়েল সায়েন্স সোসাইটি অব আমেরিকা’ (এসএসএসএ)। আর সমগ্র আয়োজনটি পরিচালনা করছে গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ (জিএসপি)।
আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ-২০১৫ এর বিভিন্ন আয়োজনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে মাটি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য জানাতে বছরজুড়ে প্রতিটি মাসের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। যেমন জানুয়ারি মাসের জন্য প্রতিপাদ্য ছিল ‘জীবন রক্ষায় মাটি’, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিপাদ্য হলো ‘শহুরে জীবনে ভূমিকা’, মার্চ মাসে ‘কৃষিতে মাটি’, এপ্রিল মাসে ‘পানি পরিশোধন ও ধারণে মাটি’, মে মাসে ‘ভবন এবং অবকাঠামো ধারণে মাটি’, জুন মাসে ‘বিনোদনে মাটি’, জুলাই মাসে ‘সজীবতায় মাটি’, আগস্টে ‘স্বাস্থ্য রক্ষায় মাটি’, সেপ্টেম্বর মাসে ‘প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় মাটি’, অক্টোবরে ‘মাটি ও আমাদের ব্যবহারযোগ্য পণ্য’, নভেম্বর মাসে ‘মাটি ও জলবায়ু’, ডিসেম্বর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘মাটি, সংস্কৃতি ও মানুষ’। প্রতিটি বিষয়ের উপর নির্মিত হয় দুই মিনিটের ভিডিও চিত্র। এছাড়া ছিল নিয়মিত সংবাদ প্রকাশনা, মৃত্তিকা সম্পর্কিত নানাতথ্য, যা সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন জানুয়ারি মাসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জীবন রক্ষায় মাটি’। সত্যিকার অর্থেই জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো-আলো, বাতাস, পানি এবং মাটি। এই চারের সমন্বয়ে উদ্ভিদের গড়ে ওঠা; যা আমাদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের যোগান দেয়। ভূ-গর্ভস্থ শিলার ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয় মাটি। অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের বাসস্থান এই মাটি। অণুজীবগুলো তাদের ক্রমাগত কার্যকলাপের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। এক টেবিল চামচ মাটিতে অণুজীবের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে মানব সংখ্যার চেয়েও বেশি! বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় মাটির ভূমিকা অনন্য। তাই বলাই যায়, মাটি জীবন ধারণ ও রক্ষা করে।
শহুরে মানুষের সাথে মাটির সম্পর্ক খুব একটা গভীর না। কিন্তু এই মাটিই শহুরে জীবনকে পূর্ণতা দিচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে। ভেবে দেখেছেন কী? আপনার পিজ্জা হাটের মজাদার পিজ্জার সাথে যে মাটির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য? পিজ্জার মুখরোচক উপাদান টমেটো, ক্যাপসিকাম, ক্লোভার, পেঁয়াজ, গাজর আর পিজ্জা ক্রাস্ট তো আসে গম থেকেই, যা মাটিতেই জন্মে। আর বীফ পিজ্জার বীফ? গরু ঘাস খেয়ে তার দেহে যে পুষ্টি নেয়, সে ঘাস তো মাটিতেই জন্মে।
মাটিতে ধারণকৃত পানি উদ্ভিদের খাবার, আবার প্রাকৃৃতিক পানি পরিশোধনেও মাটি অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। বৃষ্টির পানি মাটির উপরিভাগে বিভিন্ন রাসায়নিক সার এবং পশুবর্জ্যের সাথে মিশে দূষিত হয় এবং ভূগর্ভে চলে যায়। ভূগর্ভস্থ মাটির বুনট যদি সূক্ষ্ণ বা মিহি হয় তাহলে তা প্রাকৃতিকভাবে খুব ভালো পানি পরিশোধনকারী হিসেবে কাজ করে। আপনার পুকুরের পানি যদি পরিষ্কার দেখতে পান তাহলে ধন্যবাদ দিন মাটিকে। কারণ মাটির চেয়ে ভালো পরিশোধনকারী দ্বিতীয়টি আর নেই। ‘ইট-পাথরের দালান’ এই ইট কিন্তু বালু এবং কাদা মাটির মিশ্রণে তৈরি। আর দালান, কাঠের বাড়ি, মাটির ঘর, খড়ের ঘর, ছনের ঘর কিংবা বাঁশের ঘর যেভাবেই বলুন না কেন সব কিন্তু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাটির উপরেই। এমনিভাবে জুন মাসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বিনোদনে মাটি’- একটু হলেও অবাক হতে হয় তাই না? ছোটবেলায় বালু দিয়ে ঘর তৈরি করেছেন অনেকেই। সেখানেও তো মাটি, খেলার ছলে হলেও আপনার স্বপ্নের বালুর রাজপ্রাসাদেও মাটির উপস্থিতি। ঘোড়দৌড়ের খেলায় ঘোড়ার সুরক্ষা এবং পর্যাপ্ত শক্তির জন্য প্লে গ্রাউন্ডকে চার স্তরের অর্থাৎ চারটি ভিন্ন বুনটের মাটিতে সাজানো হয়।
খাদ্য, জ্বালানি এবং জীবন রক্ষার অন্যতম উপকরণ ঔষধের উৎসের মূল ভিত্তি হচ্ছে স্বাস্থ্যকর ও সঠিক গুণাগুন সম্পন্ন মাটি। কোনো এলাকার এক ইঞ্চি নতুন মাটি উৎপন্ন হতে ওই এলাকার জলবায়ু এবং মাটি গঠনের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে কমপক্ষে প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০ বছর সময় লাগে! যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে পানি এবং বাতাসের ক্রিয়াকলাপজনিত কারণে শুধুমাত্র চাষাবাদের জমি থেকেই প্রতিবছরে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন টন মাটি ক্ষয় হয় (সূত্র: ইউএসডিএ, ২০০৭)। বাংলাদেশ সরকারের প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর এনভায়বনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস’ (সিইজিআইএস)-এর গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী, ১৯৪৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত উপকূলে ভূমি ভাঙনের পরিমাণ ১,১৮০ বর্গ কিঃমিঃ এবং গড়ার পরিমাণ ২,৯৭০ বর্গ কিঃমিঃ এবং মোট জেগে ওঠা ভূমির পরিমাণ ১,৭৯০ বর্গ কিঃ মিঃ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) রামগতি স্টেশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পাহাড়ি এলাকায় প্রতিবছর মোট মৃত্তিকা ক্ষয়ের পরিমাণ ২.০ থেকে ৪.৭ টন/হেক্টর। এছাড়া বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার কারণে দেশের বনভূমির পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে, ফলস্বরূপ এসব এলাকায় পানি দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ১০২ টন/হেক্টর (সূত্রঃ বাংলাপিডিয়া)। মৃত্তিকার সহজলভ্যতার তুলনায় হারানোর পরিমাণটা অনেক বেশি। ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্টাল এজেন্সির (ইইএ) একটি গবেষণা রিপোর্টে দেখানো হয় যে, ইউরোপে শুধুমাত্র শিল্প কারখানাই ৬০% মাটি দূষণের জন্য দায়ি আর তাই মমতাময়ী মৃত্তিকা একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা পূরণে পাল্লা দিতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে।
প্রাকৃতিক দূর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূল হাতিয়ার হচ্ছে মাটি। মূল্যবান এই প্রাকৃতিক সম্পদ আমরা অবলীলায় প্রতিনিয়ত দূষিত করে চলেছি। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস। সঠিক পরিশোধন ছাড়াই পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে শিল্পবর্জ্য। ক্রমবর্ধমান নগরায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস, জলাবদ্ধতা এবং অপরিকল্পিত চাষাবাদ, পর্যাপ্ত জ্ঞান, সচেতনতা ও সুপরিকল্পনার অভাবে মানবসৃষ্ট কারণে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ-মাটি। মাটির গুণগতমান হ্রাসের ফলে গাছের খাদ্যের পুষ্টি উপাদানেও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে; লক্ষণীয় হচ্ছে বাস্তুসংস্থানের অসামঞ্জস্যতা। এভাবে চলতে থাকলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা খাদ্য উৎপাদনে সংকটের সম্মুখীন হব। মাটির সাথে জড়িত আমাদের উদ্ভিদরাজী, প্রাণবৈচিত্র্য, প্রাকৃৃতিক পানি সংরক্ষণ ও পরিশোধনসহ পরিবেশের অন্যান্য উপাদান। তাই মাটি দূষণ হুমকিতে ফেলবে এ সবকিছুকেই, সাথে সাথে গোটা পরিবেশ-পদ্ধতিকেও। আসুন আমরা মাটির প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করি, মাটি দূষণ রোধ করে পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি।