খিরোল কৃষকের স্বপ্নযাত্রা
:: বারসিক কয়রা খুলনা থেকে ফিরে শাহীন ইসলাম ও মফিজুর রহমান
প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ বিপন্ন একটি জনপদ বাংলাদেশের উপকূলীয় সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা। উপকূলীয় এ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ১২০ গ্রামের প্রায় আড়াই লাখ মানুষের বসবাস। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে লড়াই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় এ জনপদের মানুষের। স্থানীয়দের মতে,“বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে জলোচ্ছাস, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে নদী ভাঙন, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ মাসে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে কালবৈশাখী ঝড় মোকাবেলা করে আমরা বেঁচে থাকি। তবে, ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ সিডর ও আইলা আমাদেরকে মারাত্মক অসহায় করে দিয়েছে। পাশাপশি অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীন লবণ পানির চিংড়ি চাষ কয়রা অঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রতিনিয়ত বিপন্ন করছে। আইলার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারা এই এলাকায় বিষাক্ত লবণ পানি বিলের ও বসতভিটার জমিতে জোয়ার-ভাটা খেলছে এখনো। দেশী মাছ লবণ পানিতে সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হয়েছে। সব গাছ মরে এলাকার সবুজ পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে। তারপরও দুর্যোগের ভিতর দিয়েই আপন কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর জীবনযাত্রা ধরে রাখার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করছেন এই এলাকার প্রতিটি মানুষ।
কয়রা নদী সংলগ্ন খিরোল গ্রাম। আইলায় এই গ্রামের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আশেপাশের ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন বা গ্রাম থেকে অনেক মানুষ এসে আশ্রয় নেয় এই গ্রামে। ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ভিন্নভাবে এই গ্রামেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে আইলা। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কৃষিতে আইলা পরবর্তিত বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে এই অঞ্চলের কৃষকেরা গড়ে তুলেছেন একটি কৃষক সংগঠন। সংগঠিত হবার নজিরও পাওয়া যায় তাঁদের কর্মকান্ডে। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনের আয়োজনে তাঁরা কৃষক নেতৃত্বে নদীর বাঁধ রক্ষায় চর বনায়ন কর্মসূচি পালন করেন। আইলার ফলে বিভিন্ন পানির উৎসগুলোতে লোনা পানি ঢুকে পড়ায় বিপাকে পরে এলাকার মানুষ। এই অবস্থা মোকাবিলায় কৃষক সংগঠনের সদস্যরা সুপেয় পানির উৎস ব্যবস্থাপনার কাজ করেন। লোনা পানিতে কোন ধরনের ধান এবং সবজি উৎপাদন করা সম্ভব বা কোন ফসল উৎপাদন করলে ফলন সবচেয়ে বেশি পাওয়া সম্ভব সে বিষয়ে কৃষক নেতৃত্বে ধান ও সবজি জাত নির্বাচন গবেষণা কাজ পরিচালনা করেছেন এবং করছেন। এছাড়া কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি বিষয়ে আলোচনা, প্রশিক্ষণ, মেলা, দিবস পালন, সংলাপ, অভিজ্ঞতা বিনিময়সহ বিভিন্ন কর্মসূচি কয়রার খিরোল গ্রামের কৃষকেরা আয়োজন করেছেন।
বর্তমানে গ্রামের কৃষকেরা সংগঠনের নিজস্ব ঘর তৈরির পরিকল্পনা করছেন। সংগঠন এর কাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য নিজস্ব জায়গার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে তাঁরা এরই মধ্যে ৩ শতক জায়গা সংগঠনের নামে সরকারি নিবন্ধন করেছেন। গ্রামের পিচের রাস্তার পাশে কৃষক সংগঠনের নিজস্ব ঘর তৈরির জন্য মাটি ভরাট এর কাজও এরই মধ্যে তাঁরা সম্পাদন করেছেন। এভাবেই ধীরে ধীরে সাবলম্বী হয়ে উঠছে খিরোল গ্রামের এই কৃষক সংগঠনটি।
এভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেবার কারণে স্থানীয় সরকার সংগঠন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথেও তাঁদের পরিচয় এবং একটি সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ফলে এই সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও লাভ করছেন তাঁরা। তাঁদের ভাষায়, “ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন, কৃষি, সামাজিক বন, যুব উন্নয়নসহ অন্যান্য দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন সেবা আনতে পারছি। কয়রা উপজেলা কৃষি অফিসার আমাদের কৃষকদের সংগঠিত দেখে কৃষি ও পুষ্টি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ২৫ জন নারী ও ২৫ জন পুরুষ দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ৪ হাজার টাকা করে ভাতা, সবজি, ধান, ডাল, গম বীজ সহযোগিতা পেয়েছি। নদীর চর বনায়নের কাজ দেখে উপজেলা সামাজিক বন কর্মকর্তারা আমাদের সাথে কাজ করার জন্য যোগাযোগ করে।”
সংগঠনটির মধ্যে সহযোগিতার এবং সহভাগিতার মনোভাব থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোন বীজ ব্যাংক গড়ে ওঠেনি। কিন্তু কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য বীজের উপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি তা তাঁরা অনুধাবন করেছেন। তাই তাঁরা চেষ্টা করছেন একটি বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার। মদিনাবাদ গ্রামের কৃষক ফজর আলী, রফিকুল বিশ্বাস, আইয়ুব আলী বলেন, “আমাদের স্বপ্ন একটি কৃষক বীজ ব্যাংক ও কৃষক সংগঠনের ঘর তৈরি। আমাদের অঞ্চল দুর্যোগ প্রবণ। আইলার পর কয়রার প্রায় ৮০ ভাগ কৃষক নিজেদের সংরক্ষিত ফসলের বীজ হারিয়ে ফেলে। দুর্যোগ পাড়ি দিয়ে কৃষিজমি, পানি, চাষের গরু, লাঙল ও অন্যান্য জিনিস আবারও পুনঃউদ্ধার করা সম্ভব হলেও ফসলের বীজের চরম সংকট। তাই কয়রার কৃষি ও কৃষকের প্রাণ ফসলের বীজের চলমান সংকট নিরসন এবং দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগের পরে কৃষকের বীজ নিরাপত্তার একটি স্বাধীন বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা আমাদের প্রধান স্বপ্ন।”
এলাকার কৃষক এবং কৃষিকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি সংগঠনটি গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে নিজেদেরকে সংযুক্ত করে সার্বিক উন্নয়নের জন্যে নিরন্তর কাজ করছে।