বৈচিত্র্যই জীবন, বৈচিত্র্যই সুন্দর
সিলভানুস লামিন
বৈচিত্র্য
সাধারণত বৈচিত্র্য বলতে আমরা প্রকৃতিতে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণ ও জীবনের অস্তিত্ব ও ভিন্ন ভিন্ন জীবন আচার-আচরণকে বুঝে থাকি। আমার উপলদ্ধিতে বৈচিত্র্য বলতে শুধু প্রাণ ও জীবনের অস্তিত্বের ভিন্নতা নয় বরং জড়বস্তুসহ মানুষের মধ্যকার বয়স, লিঙ্গ, রূপ, গঠন, জাতিগত, সংস্কৃতিগত, ভাষাগত, পেশাগত, চিন্তাগত এবং ধারণাগতসহ অন্যান্য বৈচিত্র্যময় জীবনই এই বৈচিত্র্য! প্রকৃতির পাঠাশালায় হরেক রকমের উদ্ভিদ ও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। এসব জীবন ও প্রাণের প্রতিটি কর্মক্রিয়ার একটি অর্ন্তনিহিত কার্যকারণ রয়েছে। প্রতিটি ‘সৃষ্টি’র পেছনে রহস্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। এই উদ্দেশ্য ও রহস্যকে উন্মোচন করার একমাত্র সক্ষম প্রাণী হচ্ছে সৃষ্টি সেরা জীব মানুষের। সৃষ্টির এই রহস্য উন্মোচনের ক্ষমতা আবার সব মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এই রহস্য উন্মোচনের জন্য প্রয়োজন অর্ন্তনিহিত দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি, প্রয়োজন অর্ন্তদৃষ্টিও! যে অর্ন্তুদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বোস’র ছিলো! প্রতিটি ‘সৃষ্টি’র রহস্য যারা উন্মোচন করতে পারেন তারাই সৃষ্টির বৈচিত্র্যময়তার সৌন্দর্য্য অবগাহন করতে পারেন; করতে পারেন অনুভব, করতে পারেন উপভোগও। এই রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে তারা প্রতিটি সৃষ্টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন। জগদীশ চন্দ্র বোস সেটা উন্মোচন করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি বলতে পেরেছিলেন “উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে”। একটু পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যায়, প্রকৃতিতে শুধুমাত্র পাখি, জীবজন্তুর নানান রূপ, রঙ, আকার, আচরণ, কণ্ঠ, সুর, খাবার, গান এবং জীবনপ্রণালী রয়েছে। এই পাখি বা জীবজন্তুর প্রতিটি কার্যবলীর সাথে আরেকটি ‘সৃষ্টি’র অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। একটি ‘সৃষ্টি’র জীবনপ্রবাহ ব্যাহত হলে ‘অন্য সৃষ্টি’র ওপর এটি প্রভাবিত করে। এ তো গেলো শুধু পাখি বা জীবজন্তুর কথা! চোখ মেলেই আমরা দেখতে নানান বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ; প্রতিটিই অনন্য, প্রতিটিরই বিভিন্ন রঙ, রূপ, গন্ধ, গঠন, আকার, জীবনপ্রণালী রয়েছে। কোন বনে গেলে কোটি কোটি ধরনের ছোট্ট বড় উদ্ভিদ চোখে পড়ে, কোনটা বড়, কোন ছোট, কোনটার রঙ সবুজ, কোনটার রঙ লাল, হলুদ, বেগুনী। ছোট দু’টি চোখ মেলে আমরা বিশাল সমুদ্র, উদার আকাশ, দুর্গম পাহাড়, খাদ, গিরি দেখতে পাই। দেখতে পাই ক্ষুদ্রকায় প্রাণী পিঁপড়া থেকে শুরু প্রকান্ড হাতি পর্যন্ত। এই চোখেই আবার আমরা দেখতে পাই নানান ধরনের মৃত্তিকার গঠন, রঙ, উৎপাদনশীলতা, দেখতে পাই উদ্ভিদের নানান ধরনের ও রঙের ফল, ফুল। এ সব সৃষ্টির মূলে রয়েছে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। তাই তো বৈচিত্র্যকে সংজ্ঞায়ন করার দুঃসাহস কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ও ভাষার অভিধানগুলোতে ‘বৈচিত্র্য’র পুরিপূর্ণ সংজ্ঞা নেই। কেউ কেউ বৈচিত্র্য বলতে সৃষ্টির ভিন্নতাকে বুঝিয়েছেন, কেউ জীবনের গঠন ও জীবনপ্রণালীর পার্থক্যকে বুঝিয়েছেন, কেউ বুঝিয়েছেন প্রকৃতির পরতে পরতে পরিলক্ষিত পরিবর্তনকে, কেউ কেউ আবার মানুষের চিন্তা-ভাবনা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, অনুধাবনের পার্থক্যকে বুঝিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, বৈচিত্র্য বলতে শুধু এটুকু বোঝায় না; বৈচিত্র্যের পরিধি আরও ব্যাপক, আরও প্রসারিত, আরও গভীর। একে সংজ্ঞার ভেতরে আটকে রাখা যায় না, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না, একে কেবল অনুভব করা যায়। কারণ আমাদের চোখের ধারণক্ষমতা বা দৃষ্টিগোচরতার বাইরেও আরও অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে; আরও অনেক জীবন, প্রাণ বা অস্তিত্ব রয়েছে যেগুলো কোন না কোনভাবে মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টির জীবনপ্রবাহকে ছন্দ দেয়, দেয় নিরাপত্তা! তাই প্রতিটি মানুষের উচিত হবে এই বৈচিত্র্যকে আরও গতিশীলতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করা, এই বৈচিত্র্যের আন্তঃসম্পর্ক, এদের মধ্যকার যোগাযোগ, মিথষ্ক্রিয়া এবং নির্ভরশীলতার বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করা। সবার দেখা, চিন্তা ও স্বপ্নের ভিন্নতাকে একসাথে করে নিয়ে এবং জীব ও জীবনের আনন্দকে সঙ্গী করেই আমরা এগিয়ে যাবে!
বৈচিত্র্যই জীবন
পৃথিবীতে শুধুমাত্র মানুষ নয়; উদ্ভিদ ও প্রাণীসহ প্রতিটি ‘সৃষ্টি’রই এই বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা খাদ্যের জন্য, বাসস্থানের জন্য, ওষুধের জন্য, নিরাপত্তার জন্য, শাস্ব-প্রশ্বাস গ্রহণের জন্য এবং সর্বোপরি জীবনপ্রবাহকে তার আপন নিয়মে পরিচালনার জন্য! এই নির্ভরশীলতা পরিপুষ্ট হওয়ার জন্য, বিকশিত হওয়ার জন্য, উৎপাদনের জন্য, নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্য এবং বেঁচে থাকার জন্য। বৈচিত্র্যকে বাদ দিয়ে জীবনের ভেতরে কখনও প্রাণের সঞ্চার হতে পারে না। এই বৈচিত্র্যময়তার জন্যই তো আজও জীবন টিকে আছে, আজও আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছি। এই বৈচিত্র্যময়তার জন্য আজও আমরা সুস্থ আছি, আজও আমরাসহ প্রকৃতির অন্যান্য ‘সৃষ্টিগুলো’ মাথা উচু করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মশা আছে বলেই আজও ব্যাঙ আছে, ব্যাঙ আছে বলে আজও সাপ আছে, কেওড়াসহ অন্যান্য উদ্ভিদ আছে বলে আজও সুন্দরবনে হরিণ আছে, হরিণ আছে বলে সুন্দরবনে এখনও বাঘ আছে। নানান উদ্ভিদ ও গুল্ম আছে বলে আজও বিভিন্ন পোকামাকড়, প্রজাপতিসহ অন্যান্য সুন্দর ক্ষুদ্র প্রাণী আছে। গাছ আছে বলে আমরা এখনও অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে আছি, নদী আছে বলে আজও মাছ আছে, বন আছে বলে আজও অনেক পশু-পাখি, জীবজন্তু আছে। এভাবে আমরা একে একে যদি বিশ্লেষণে যাই তাহলে দেখতে পাবো শুধুমাত্র খাদ্যের জন্য একটি প্রাণীর অস্তিত্ব আরও একটি প্রাণীর ওপর নির্ভর করে। এতো গেল শুধুমাত্র খাদ্যের ওপর নির্ভরশীলতা! খাদ্য ছাড়াও প্রতিটি প্রাণীর সুস্থ জীবন ও বিকাশের জন্য আরেকটি প্রাণী বা উদ্ভিদ পরিপূরক ভূমিকা পালন করে। একইভাবে উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটি বড় বটের ওপর আরও অনেক পরগাছা গুল্ম বা উদ্ভিদ জমে; আশ্রয় নেয়। একটি উদ্ভিদের সাথে আরেকটি উদ্ভিদের ‘বন্ধন’ রয়েছে, যা হয়তো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না! উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার বন্ধন ও সম্পর্ক আরও নিবিড়, আরও অর্থপূর্ণ। অনেকগুলো প্রাণীর খাদ্য হচ্ছে এই উদ্ভিদ আবার অনেক উদ্ভিদের জন্মের (পরাগায়ন) পেছনে প্রাণীর অবদান রয়েছে। প্রকৃতিতে সব ধরনের সৃষ্টিগুলোই পরস্পরের সাথে সম্পর্কশীল ও নির্ভরশীল। এই সম্পর্ক যে কতটা গভীর, কতটা অটুট এবং কতটা নির্মল তা উপলদ্ধি করা সত্যিই কঠিন! এই বৈচিত্র্য যদি না থাকে এসব জীবন, বা প্রাণের কোন অস্তিত্ব থাকে না; থাকতে পারে না। মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের সাথে আরেকটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের যেমন একটি সেতুবন্ধন ও সংযুক্ততা রয়েছে এবং একটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিকল হলে পুরো দেহটার ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয় ঠিক তেমনি প্রকৃতিতে একটি ক্ষুদ্র উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ধ্বংস হলে এ ‘মহাসৃষ্টির’ও ভারসাম্য নষ্ট হয়। তবে দুঃখের সাথেই বলতে হয়, এই বৈচিত্র্যময় জীবন ও প্রাণের মধ্যকার যোগাযোগ, নির্ভরশীলতা, আন্তঃসম্পর্ক এবং মমতার বন্ধনকে ছিন্ন করার দুঃসাহস আমরা মানুষেরাই করেছি; প্রকৃতির কোন প্রাণী, বা উদ্ভিদ অথবা অন্য কোন জীবন নয়। মানুষের উন্নয়ন করার স্বার্থে আমরাই এই বন্ধন ছিন্ন করেছি, ধ্বংস করেছি। তাই তো আজ বিশ্বে হাজার হাজার প্রাণ ও জীবনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। এই বিলুপ্তি কোনভাবে মানুষের কল্যাণ করেনি; করেছে বিপদগ্রস্ত। তাই আমাদের আগামী দিনের পথচলাই হবে এই বৈচিত্র্যময়তার মধ্যকার সম্পর্ক, নির্ভরশীলতা এবং মমতার বন্ধনকে পুনঃসংযুক্ত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করা। সেক্ষেত্রে সব উন্নয়ন উদ্যোগ অবশ্যই নির্ধারিত হবে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণকে বিবেচনা করে নয় বরং সমগ্র জীবন ও প্রাণের মধ্যকার কল্যাণকে বিবেচনা করেই! কারণ আমরা মনে করি বৈচিত্র্যের মাঝেই আছে ‘জীবন’, আছে স্পন্দন!
বৈচিত্র্যেই সৃষ্টি, বৈচিত্র্যই আবিষ্কার
নতুন কোন কিছু আবিষ্কার, উদ্ভাবন বা সৃষ্টির জন্য বৈচিত্র্য থেকেই মানুষ অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা পায়। পৃথিবীতে নানান বৈচিত্র্য আছে বলেই কবি বা সাহিত্যিকদের কলমের আঁচড়ে প্রাণ ও প্রকৃতির জীবনঘনিষ্ঠ ‘সম্পর্ক’ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়; শিল্পীদের তুলিতে জীবন ও প্রাণের অদ্ভুদ সৌদর্য ফুটে ওঠে, জাগ্রত হয় স্পন্দন! প্রকৃতির পাঠশালায় প্রতিটি বৈচিত্র্যকে পাঠ করে তাঁরা মানুষকে নতুনভাবে বাঁচার, জীবনকে উপভোগ করার এবং প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি যত্নবান হওয়ার মন্ত্র শিখিয়ে দেন। কে জানে এ বৈচিত্র্য যদি না থাকতো নতুন কোন সৃষ্টি বা উদ্ভাবন হতো কি না! মানুষের বৈচিত্র্যময় চিন্তা, ভাবনা, ধারণা, জ্ঞান এবং উপলদ্ধি আছে বলেই নিত্যনতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তি এসেছে, মানুষের জীবনকে সহজতর করে তুলেছে! এডুয়ার্ড ডিবোনো’র মতে, পৃথিবীতে ৬ ধরনের চিন্তাধারী (সিক্স থিংকিং হ্যাট) মানুষ রয়েছেন। এ ৬ ধরনের চিন্তাধারী মানুষের চিন্তাকে সমন্বয় করেই নতুন একটি সৃষ্টি, জ্ঞান, বা আবিষ্কার হাজির হয়; বিশ্বে তৈরি হয় নানান আইনকানুন, নিয়মনীতি, গাইডলাইন, বিধিবিধান, দক্ষতা বিষয়ক নানান নথিপত্র, যা মানুষের সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য প্রয়োজন। অন্যদিকে মানুষ তাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূলমন্ত্র পায় প্রকৃতি থেকেই! ছোট পিঁপড়াগুলো যখন দলবেঁধে কাঁধে বিশাল খাদ্যের বোঝা নিয়ে তাদের আবাসস্থলে খাদ্য মজুদ করে রাখে কিংবা মৌমাছি যখন বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ‘চাকে’ জমা করে রাখে তখন মানুষও তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয় কীভাবে তাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আকাশে উড়ন্ত পাখি দেখে মানুষের সাধ জাগে আকাশে উড্ডয়নে; তারা আবিষ্কার করেন উড়োজাহাজ, সমুদ্রে মাছের বিচরণ দেখে মানুষের ইচ্ছা জাগে সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে সমুদ্রের রহস্য উন্মোজন করার; তারা আবিষ্কার করেন সাবমেরিন জাহাজ, সূর্যের আলো দেখেই অন্ধকারকে দূরীভূত করার জন্য মানুষ ‘কৃত্রিম আলো’ আবিষ্কার করেন। প্রকৃতিতে থেকে বিভিন্ন ধরনের পাখি, পোকামাকড়, জীবজন্তু ঘরনির্মাণের নকশা দেখে মানুষ নিত্যনতুন নকশার বাড়িঘর নির্মাণ করেন। এভাবে প্রতিটি উদ্ভাবনের বা আবিষ্কারের উৎসমূলই হচ্ছে এই বৈচিত্র্য! প্রতিটি সৃষ্টির, আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা আসে এই বৈচিত্র্য থেকে। প্রকৃতিতে যদি এই বৈচিত্র্য না থাকতো তাহলে পৃথিবীতে আজ আলোড়ন সৃষ্টিকারী, বিস্ময় জাগানিয়া কোন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন দেখা যেতো না। তাই আমাদের সবারই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিত যে প্রকৃতির বুকে প্রতিটি সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখবো, আরও উন্মোচিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবো। এসব সৃষ্টি বা আবিষ্কার যাতে শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয় বরং প্রকৃতিতে প্রতিটি প্রাণ ও জীবনের কল্যাণ নিশ্চিত করে তার দিকে নজর দেবো। কারণ অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষের এই ‘উদ্ভাবন’ মানুষের কল্যাণ করলেও প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের ক্ষতি করে। সেক্ষেত্রে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবো যে, প্রকৃতিতে এবং মানুষের মধ্যকার বৈচিত্র্যকে সম্মান, সুরক্ষা ও স্বীকৃতির মাধ্যমেই আমরা আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে এসব ‘উদ্ভাবন’ ও সৃষ্টিগুলো মানুষসহ সব ধরনের প্রাণ ও অস্তিত্বের জন্য আর্শীবাদরূপে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা চালাবো।
বৈচিত্র্যই সুন্দর
প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর! উদ্ভিদে উদ্ভিদে, প্রাণীতে প্রাণীতে এবং মানুষে মানুষের ভেতরে এই বৈচিত্র্যময়তা পৃথিবীকে অনন্য একটি রূপ দিয়েছে। শীতের সকালে কুয়াশার চাঁদর ভেদ করে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর সূর্যের আলো বিকিরণে যে সৌন্দর্যের ঝিলিক দেখা যায়, কিংবা শরতের কাঁশবন, শিউলি ফুল, বর্ষার জল ভরা মেঘ বা ফাগুনের কৃষ্ণচুড়ার সৌন্দর্যগুলো সত্যিই আমাদেরকে বিমোহিত করে তুলে; অসম্ভব ও প্রচন্ড এক ভালোলাগার অনুভুতি দেয়! প্রকৃতিতে অকৃত্রিম অবকাঠামো তথা ঝর্ণা, বিল, ডোবা, পাহাড়, সমুদ্র মানুষকে শুধুমাত্র বিনোদিত করে না; বরং জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষাও দেয়। আবার বিভিন্ন সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, গোত্র, বয়স, সংস্কৃতি ও পেশার মানুষের ভেতরকার ‘মিলনমেলা’, ‘সংহতিবন্ধন’গুলো আমাদের আশা জাগিয়ে তুলে। এই একাত্মতার সুর এবং সৌহার্দ্যবন্ধনের জন্যই পৃথিবীকে আজ মানুষ জয় করেছে, অসাধ্য সাধন করেছে। পাহাড়ের গহীনে, সমুদ্রের অতল তলে কিংবা আকাশের বুকে অসংখ্য পাখি, মাছ ও জীবজন্তুর বিচরণ আমাদেরকে মুগ্ধ করে! কিংবা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ, ফুল, ফল, গুল্ম, লতা, পাতার বাহারী রূপ ও রঙগুলো আমাদের ভেতরে একটি সুখানুভুতি তৈরি করে। এ সুন্দর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য, মায়া এবং টান বংশপরম্পরায় মানুষকে খুব কাছে টানে, আপন করে নেয়। এগুলোর গঠন, কাঠামো, রূপ বা অবয়বে বৈচিত্র্য আছে বলেই এগুলো আমাদেরকে কাছে টানে, আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে দেয়! নানান ভাষা, গান, কবিতা, সাহিত্য, আচার-আচরণ, প্রথা, সমাজকাঠামো, কৃষি-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য আছে বলেই মানুষের জীবনচলার পথটার পরতে পরতে সৌন্দর্য্য বিছিয়ে আছে। এই সৌন্দর্য্যকে অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়; আত্মা নিয়ে উপলদ্ধি করতে হয়। তাই বলা যায়, প্রকৃতিতে মানুষসহ অন্যান্য জীব ও প্রাণীর সহ-অবস্থান যখন নিশ্চিত হয় কেবলমাত্র তখনই প্রকৃতিতে এবং মানুষের জীবনের ক্যানভাসে এই সৌন্দর্য্যগুলো প্রষ্ফূটিত হয়। এই অকৃত্রিম সুন্দর বৈচিত্র্যময়তার কাছ থেকে মানুষের শেখার ও জানার অন্ত নেই; জানার ও বুঝবার পরিসর নেই! তবে এসব প্রাণের সমাহার, জীবনের বিচরণ দিনকে দিন স্থবির হয়েছে বলে, হ্রাস পেয়েছে বলে আজ মানুষের এই সৌন্দর্য্য অবগাহন কিছুটা হলেও স্থিমিত হয়েছে। তাই্ আসুন আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমাদের আগামী দিনের পথচলাই হবে বৈচিত্র্যের মাঝে যে সৌন্দর্য্য আছে সেটার প্রকাশ ও বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। এই সৌন্দর্যকে রক্ষা, প্রকাশ ও বিকাশ করার জন্য আমাদের প্রতিটি উদ্যোগে এলাকার মানুষসহ অন্যান্য প্রাণ ও জীবনের যুক্ততা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করবো। নানান পেশার, শ্রেণীর, বয়সের মানুষের সংযুক্ততা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমেই আমরা বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে পারবো , সুরক্ষা দিতে পারবো এবং স্বীকৃতি দিতে সমর্থ হবো। এভাবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে বৈচিত্র্যের মাঝে ‘জীবন’ জেগে উঠবে, বৈচিত্র্যের মাঝে ‘সৌন্দর্য্য’ বিকশিত হবে। এই ভিন্নতার মাঝে ‘ভিন্নতাকে’ নিয়েই আমরা একটি ‘বাসযোগ্য’ পৃথিবী গড়তে চাই সবার জন্য!