করুণা রানীর বিষমুক্ত কৃষি

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

‘বর্ষার সময় চারিদিকে জল আর জল। একটু একটু করে জল বাড়তে থাকে। যখন ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ভরনা দেয় (একটানা বর্ষা হয়) তখন ক্ষেতের ভিতর পানি উঠে। আর এ পানি ঘরের সামনে উঠানেও চলে আসে তখন একদিকে উঠানে শুধু জল আর জল। আর এ জলে ক্ষেত ডুবে সব শাকসবজি নষ্ট হয়ে যায়। শুধু মাত্র গ্রীষ্মকালীন সময়ে কিছু জায়গায় আলু লাগাতে পারি। এরপর ২০১৪ সালের দিকে বারসিক’র নিকট আমার এ সমস্যার কথা জানলে তারা আমাকে বসতভিটা উচুকরণে সহযোগিতা করে। যার ফলে ২০১৫ সাল থেকে আমি সারাবছর এ ভিটায় সবজি চাষ করতে পারছি। গত ৩০ বছর ধরে এ বাড়িতে সবজি করলেও এতো সবজি হতো না এখন যেমন হচ্ছে।’

সবজি ক্ষেতে সবজি উঠাতে উঠাতে এভাবে উপরোক্ত কথাগুলো বললেন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের বেতাঙ্গী গ্রামের কৃষাণী করুণা রানী মন্ডল (৭০)। ছেলে, ছেলের বৌ ও তিন পুতনীসহ ৬ জনের সংসার তাঁর। ছেলে মাছের কাটায় (পাইকারী মাছের আড়ৎ) মহুরীর কাজ করে দৈনিক ১০০ টাকা মজুরি পায়। এ আয় দিয়ে ৬ জনের সংসার চালতে খুব কষ্ঠ হয়। জায়গা-জমি বলতে ১০ কাঠার বসত ভিটা। আড়াই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করেন। যে ধান হয় তা দিয়ে ৬ মাস খোরাকী হয় বাকি ৬ মাস চাউল কিনে খেতে হয়। তাই সারাবছর তিনি বসত ভিটায় শাক সবজির আবাদ করেন সংসারের চাকাকে সচল করার জন্য।

শাকসবজি ক্ষেতে কোন রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহার করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি সবজি চাষে বাজারের কোন সার দিই না। বাজারের সারে মাটি ঝাই (শক্ত) হয়ে যায়, মাটিতে কোন শক্তি থাকে না। বাজারের সার দিলে গাছে বেশি পোকা লাগে। কিন্তু বাড়ির তৈরি সার দিলে পোকা কম লাগে। আমার সবজি ক্ষেতে আমি গোবর, ছাগলের নাদি, নাড়া পচা, ঝাটলে জোনজাল (বাড়ির কুড়ানো আবর্জনা) পচিয়ে মাটিতে দিয়ে দানা (বীজ) পুতি। এছাড়াও আমার ৩টি কেচো কম্পোস্ট আছে। বাড়ির তৈরি সারে মাটি ঝুরঝুরে থাকে। এছাড়া পোকামাকড় দমনের জন্য ঘুটের ছাই (গোবর পোড়ানো ছাই) এর সঙ্গে কেরোসিন মিশিয়ে গাছে ছিটিয়ে দেই। এতে যদি পোকা দমন না হয় তখন তামাক পাতা ভিজিয়ে রেখে তামাকের জল দিয়ে স্প্রে করি।”

pic-2
এ বর্ষা মৌসুমে তিনি পুঁইশাক, চালকুমড়া, শসা, লাউ, তুরুল, ম্যানকা, কুশি, ঝিঙ্গা, ঢ়েঁড়স, ডাটাশাক, চুই ঝাল, মানকচু, উচ্ছে, বরবটি, কচুরমুখী ও হলুদ চাষ করেছেন। তার মতে, জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়েছে। নিজের উৎপাদিত সবজি দিয়ে তিনি নিজের পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পুরণ করছেন। অনেক সময় আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশি তার কাছ থেকে বিষমুক্ত শাক-সবজি কিনে নিয়ে যায় আবার অনেক সময় তিনি অনেককে বিনামুল্যে দিয়ে থাকেন। এতে করে তাদের সাথে সুসম্পর্কের জায়গা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া অতিরিক্ত সবজি বিক্রির জন্য বাজারে যাওয়া লাগে না। গ্রামে মধ্যে ঢুকলে এবং অনেক সময় বাড়ি থেকে এসে সবজি কিনে নিয়ে যায়।

করুণা রানীর বাড়িতে আম, জাম, লেবু, ছবেদা, পেয়ারা, নারকেল, কুল, ডালিম, জামরুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছও আছে। গ্রামের কৃষক ও কৃষাণী অনিতা, মায়া, বিনয় জানান, করুণা রানীর সবজিতে আলাদা স্বাদ আছে। যে জন্য তারা তাঁর বাড়ি থেকে সবজি কিনে নিয়ে যান। এছাড়া গ্রামে সবজি বিক্রি করতে গেলে আগে তাঁর সবজি বিক্রি হয়ে যায়। এতে করে করুণা রানীর একটি বাড়তি আয় হয়। মাসে সবজি বিক্রি করে প্রায় ৩০০০ টাকার মতো আয় করেন তিনি। যা দিয়ে তিনি পুতনীদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের অন্যান্য খরচে ছেলেকে সহযোগিতা করতে পারছেন। এবছর সবজি বিক্রি করে একটি মটর কিনেছে যাতে বারোমাস সবজি চাষ করতে পারেন। সারা বছর কোন না কোন সবজি থাকে তাঁর ক্ষেতে।

pic-1
করুণা রানী বলেন, ‘প্রত্যেক মৌসুমের জন্য আমি বীজ সংরক্ষণে রাখি এবং আমার কাছ থেকে অনেকেও বীজ নিয়ে যায়। বাজারে কেনা বীজের উপর আমার কোর ভরসা নেই। এছাড়া বীজ সংরক্ষণে ফল গাছে আধাপাকা করে রেখে সে ফলটি থেকে বীজ রাখি। নিত্যদিনের ব্যাবহারের জন্য শুধুমাত্র তেল, মসলা, কেরোসিন ও আলু ছাড়া অন্য কোন সবজি কিনতে হয় না।’ তিনি জানান, যে সকল সবজি বাড়িতে চাষাবাদ করেন না সে সকল সবজি মাঝে মাঝে শখ করে ছেলে বাজার থেকে কিনে আনেন কিন্তু যে সাজে/ওয়াক্তে বাজারের সবজি রান্না করা হয় সে সাজে প্রায় সময় তিনি নিজের জন্য বাড়ির আশপাশ থেকে খোটা (অচাষকৃত) শাক সংগ্রহ করে রান্না করেন। বাজারের কেনা সবজি না খাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বাজারের সবজিতে কোন স্বাদ পাইনা। বাজারের সার-বিষ দেওয়া সবজি খেলে রোগ ব্যাধি বেশি হয়।”

pic-3
করুণা রানী জৈব উপায়ে শাকসবজি চাষাবাদের পাশাপাশি তিনি হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন করে সংসারের আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছেন। বর্তমানে তাঁর ১০টি ছাগল, ৩টি গরু, ৫টি মুরগি, ৭টি হাঁস আছে। করুণা রানীর মত উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক নারী আছেন যারা পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চা করে পারিবারিক আয় ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখছেন।

happy wheels 2

Comments