ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ রক্ষায় একটি সফল উদ্যোগ

শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান

 

 দেশের সর্বাধিক দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ জনপদ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুর। খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদ বেষ্টিত পদ্মপুকুর ইউনিয়ন আইলায় লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সেই থেকে আজও ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়নের চারপাশের ৩৪ কিলোমিটার বেঁড়িবাধ। সরকারের দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ না থাকায় পদ্মপুকুর ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণ সম্পূর্ণ লোকায়ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বেঁড়িবাধ সংস্কার শুরু করেছে।

সরকারিভাবে বেড়িবাঁধ সংস্কারে বিভিন্ন সময় কাজ হয়। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। কারণ নদীর চরের মাটি কেটে বাঁধ উঁচু করা হয়। স্থানীয়রা মনে করেন জিআই বস্তায় বালু ভর্তি করে ব্লক ফেলে কাজটি করলে স্রোতের গতি কিছুটা কমবে ও পলি পড়বে। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয়রা ভাঙন রোধে পরীক্ষামূলকভাবে নেট দিয়ে ঘিরে তার ভিতর ইটের টুকরা ফেলে চর পড়ে কিনা সেটা দেখার চেষ্টা করছেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে কামালকাটি গ্রামের দুইটি স্থানে নেট, বাঁশ ও ইটের টুকরা দিয়ে ডোল তৈরি করা হবে। স্থানীয়ভাবে চাঁদা তুলে এই কাজ করা হচ্ছে। কারণ ভাঙন রোধ করা গেলে পদ্মপুকুর ইউনিয়নবাসী বাঁচবে। বারসিক পদ্মপুকুর জনগোষ্ঠীর বাঁধ সংস্কারের আন্দোলনকে তথ্য, পরামর্শ ও যোগাযোগে সহায়তা করছে।

পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম বলেন, “আইলা হয়েছে ২০০৯ সালে, কিন্তু আজও ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কার করা হয়নি। কামালকাটি গ্রামের বেড়িবাঁধ যে কোন সময় নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “জিআই বালু ভর্তি বস্তা ফেলে যদি ডামপিং করা হয়, তা হলে এই ভাঙন রোধ করা সম্ভব। কামালকাটি গ্রামের বাঁধ ভাঙলে সমগ্র পদ্মপুকুর ইউনিয়ন তলিয়ে যাবে। এই মুহূর্তে জিআই বালু ভর্তি বস্তা ফেলে যদি ডামপিং করা হয় তা হলে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা খরচ হবে। কিন্তু ভেঙে নদী গর্ভে বিলীন হলে তা সংস্কার করতে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হবে।

Presentation1

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটি গ্রামের প্রবীণ দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল (৮৫) বলেন, “আমাদের গ্রামের বেড়িবাঁধ যে কোন সময় ভেঙে যেতে পারে। অতি দ্রুত বেড়িবাঁধ সংস্কার করা না হলে যে কোনসময় ভেঙে আবারও আইলার মত অবস্থা হতে পারে। ভাঙনের কারণে অনেকের ঘর বাড়ি বার বার স্থানান্তর করতে হচ্ছে। আবার অনেকে ঘর বাড়ি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে অনেক পরিবার দেশান্তর (ভারত) হয়ে গেছে। নদী ভাঙনের ফলে আমার বাড়ি ৫বার সরিয়ে অন্য স্থানে তৈরি করতে হয়েছে। আমার জায়গা জমি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।”

এর আগে স্থানীয়রা গত ২৮ এপ্রিল ২০১৫ শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটিতে ভাঙন কবলিত নদীর পাড়ে খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধনের খবর তেরটি জাতীয় পত্রিকা, সাতটি স্থানীয় পত্রিকা এবং দশটি টিভি চ্যানেলে প্রকাশ/প্রচার হয়। পরবর্তীতে ২৬ জুলাই সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসানের কাছে বারসিক ও স্থানীয়রা স্মারকলিপি পেশ করে।

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের প্রায় সহস্র অধিক মানুষ স্বাক্ষরিত এই স্মারকলিপিতে বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলের সর্বাধিক দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ জনপদ শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুর। এই ইউনিয়নের কামালকাটি গ্রামের খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে চরম ঝুঁকিতে বসবাস করছে পদ্মপুকুরের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ পদ্মপুকুর ইউনিয়ন রক্ষায় আইলার পরে এখনো কোন স্থায়ী বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় ম্লান হয়ে যাচ্ছে সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকান্ডও। বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও খাদ্য নিরাপত্তা। স্মারকলিপি প্রদানের সংবাদটি ৯টি জাতীয় পত্রিকা, ৩টি স্থানীয় পত্রিকা, ৩টি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ হয়।

এই প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান বলেন, “সুন্দরবন সংলগ্ন অধিকাংশ নদ-নদীর বাঁধগুলো ৫০-৬০ বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল। এরপর নতুন করে আর বাঁধ নির্মাণ না করায় সবগুলো ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি এবং পাউবোকে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কারের নির্দেশনা দিয়েছি”।

স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কামালকাটি গ্রামের সব থেকে ঝুকিপূর্ণ স্থানের সাইড দিয়ে নতুন করে রাস্তা তৈরি করেছে।

happy wheels 2