বরেন্দ্র অঞ্চলের সংস্কৃতি ও কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে মো. শহিদুল ইসলাম ও অমিত সরকার

 

বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক এর যাত্রা

সমাজে কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা নিজস্ব চিন্তা ও উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে দেশ, জাতি ও সমাজ বির্নিমাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। নিজেদের আলোয় তাঁরা আলোকিত করেন এলাকার অন্য মানুষকেও। সেরকম একজন আলোকিত মানুষ হচ্ছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের তানোর উপজেলার পাচন্দর ইউনিয়নের কৃষক মো. ইউসুফ মোল্লা (৬০+)। তিনি প্রায় ৩৫০ দেশী প্রজাতির ধান ও প্রায় ৫০ প্রজাতির শস্য ও সবজি বীজ সংগ্রহ ও চাষ করে এলাকার মানুষের বীজ চাহিদা পূরণ করেছেন এবং হারিয়ে যেতে বসা ধানগুলো সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মদের মাঝে পরিচিত করে তুলেছেন। তাঁর এ উদ্যোগের কারণেই ২০১৩ সালে তিনি পেয়েছেন রাষ্টীয় পরিবেশ সম্মাননা। সোনাকাঠি ধানের বীজ সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করেন মো. ইউসুফ মোল্লা। নিজ এলাকাসহ আস্তে আস্তে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেশী জাতের ধান বীজ সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল দেশী বীজ ভান্ডার। এলাকার কৃষকদের নিয়ে গঠন করেন দুবইল কৃষক মাঠ স্কুল। দুবইল গ্রামের সেই কৃষক মাঠ স্কুলের উদ্যোগে ৩৫০ জাতের ধান বীজ ও ৫০ জাতের সশ্য ও সবজি বীজ নিয়ে গত ৩০ পৌষ-১৪২২ পৌষ সংক্রান্তি পালনের মধ্যে দিয়ে বীজ ভান্ডার বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য বরেন্দ্র “বীজ ব্যাংক’উন্মুক্ত করে দেন তিনি।

 

1

 

বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তথা-রাজশাহী, নওগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর এর কিছু অংশ নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের গঠিত। বাংলাদেশেসহ সন্নিহিত জনপদগুলোর আদি এবং প্রথম মানব বসতির স্থান বলা হয় এই বরেন্দ্র অঞ্চলকে। ইতিহাস, কাব্য, পুরাণ, বর্তমান সময়ের উদ্ধারকৃত শীলালিপি এবং প্রতœতত্ত্ব অনুসন্ধানসহ প্রবীণদের কাছ থেকে অঞ্চলটির হাজারো রূপ আর নিজস্ব স্বকীয়তার কথা জানা যায়। অতীতে বরেন্দ্র অঞ্চল ছিল ঐর্শ¦য্যমন্ডিত বিভিন্ন প্রাণের এক নিরাপদ ভূমি। কিন্তু ষাট পরবর্তী সত্তর দশকের পর থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের বুকে নেমে আসে এক অস্বাভাবিক পরিবর্তন। বৃক্ষ তরু-লতা দিনে দিনে কমতে থাকে, একই সাথে পরিবর্তন হতে থাকে ফসল চাষাবাদের ধরন। এই অঞ্চল উপযোগী হাজারো ধান এবং শস্য ফসল চাষবাস না করার কারণে ধীরে ধীরে বৈচিত্র্যময় শস্য-ফসল কমতে থাকে; অনেকগুলো হারিয়েও গেছে। এসব ফসলের জায়গায় চাষ হয় শুধু পানিনির্ভর ধান। ভৌগোলিক কারণেই বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটির ধরন আলাদা এবং সঙ্গত কারণেই এখানকার চাষাবাদের ধরনও আলাদা ছিলো। একদিকে উপযোগী জাত হারানো, অন্যদিকে প্রকৃতির বিরূপ ভাবাপন্ন, সব মিলে কৃষক দিশেহারা। এমতাবস্থায় বরেন্দ্র অঞ্চলের সচেতন কৃষকরা বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় বরেন্দ্রর নানা প্রান্ত থেকে উপযোগী ধান শস্য ফসলের বীজ সংগ্রহ করে সেগুলো সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করেন; পরস্পরের সাথে বিনিময় করেন। এভাবে দিনে দিনে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ সারা বাংলাদেশের একজন কৃষক থেকে আরেক কৃষকের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে উপযোগী বীজ সংগ্রহ করে নিজের বাড়িতে সংগ্রহ করেন মো. ইউসুফ মোল্লা। ২০১০ সালে তাঁর বাড়িতেই গড়ে ওঠে বীজ ব্যাংক। এভাবে ধীরে ধীরে ধান গবেষক হিসেবে পরিচিত কৃষক নুর মোহাম্মদসহ আরও অনেক কৃষক এলাকার উপযোগী স্থানীয় ফসলের বীজ সংরক্ষণে আগ্রহী হয়ে উঠেন। কৃষকরা সিদ্ধান্ত নেন বরেন্দ্র অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা, বীজের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং এলাকা উপযোগী বীজের সমস্যা সমাধানসহ মো: ইউসুফ আলী মোল্লার নেতৃত্বে সবাই মিলে একটি বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার। এভাবেই বরেন্দ্র “বীজ ব্যাংক’ যাত্রা শুরু হয়।

 

সংক্রান্তি পালন বীজ ব্যাংক উদ্বোধন অনুষ্ঠান

ইউসুফ মোল্লা কৃষক মাঠ স্কুল এর উদ্যোগে এবং বারসিকের সহায়তায় গত ৩০ পৌষ, ১৪২২ তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের স্কুল মাঠে দিনব্যাপী বিভিন্ন জাতের ধান ও সশ্য ফসলের বীজ প্রদর্শন ও পিঠা-পুলি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এ দিনে পৌষ সংক্রান্তি পালন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে “বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক’ উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাধুনী পাগল ও দাদখানি চালের ভাত দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করা হয়। মোঃ ইউসুফ মোল্লার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বীজ ব্যাংকের উদ্বোধন করেন তানোর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া। অন্যান্যদের মধ্যে অলোচনায় অংশ নেন তানোর উপজেলার কৃষিকর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম, “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২০” পদকে ভূষিত বরেন্দ্র স্বজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সামসুদ্দীন মন্ডল, সংকরায়নের মাধ্যমে ধানজাত উদ্ভাবনকারী কৃষক মো. নূর মোহাম্মদ, বারসিক’র সমন্বয়কারী এবিএম তৌহিদুল আলম, চাঁপাইনবাবগঞ্জএর বিশিষ্ট সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন দিলু, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রগতিশীল নারীদের সংগঠন জাগো নারী বহ্নিশিখা এর সদস্য সচিব মনোয়ারা খাতুন প্রমূখ।

ইউসুফ আলী মোল্লা স্বাগত বক্তব্যে বলেন, “দিন দিন আমাদের মধ্যে থেকে ধানের বৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন ধানগুলো নাম্বারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আগের মতো আর ধানের সেই বাহারী নাম নেই। বাহারী রঙ নেই, নেই বাহারী স্বাদও!” তিনি বলেন, “দেশীয় ধান রক্ষায় এবং এলাকা উপযোগী ধান সন্ধানের জন্য দীর্ঘদিন থেকেই আমি দেশী জাতের ধানগুলো সংগ্রহ করি। আজ আমার কাছে সব মিলিয়ে ৪০০ প্রজাতির ধান ও শস্য ফসল সংগ্রহে রয়েছে। আমি আমার এই সংগ্রহশালা আজ বরেন্দ্র অঞ্চলসহ সারা দেশের সব কৃষকের জন্য উন্মুক্ত করতে চাই।” তিনি আরও বলেন, “যেকোন কৃষক আমাদের এখান থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পারবে। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি একদিন আবার সেই দিন ফিরে আসবে। কৃষকরা সবাই জৈব পদ্ধতিতে কৃষি ফসল উৎপাদন করবেন। মাঠে মাঠে সবুজ বিপ্লব ঘটবে বৈচিত্র্যময় ফসলের মধ্যে দিয়ে।”

অনুষ্ঠানে “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২০” পদকে ভূষিত বরেন্দ্র স্বজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সামসুদ্দীন মন্ডল এবং জয়িতা সম্মাননা প্রাপ্ত মোছা: কবুলজান বেগমকে বরেন্দ্র অঞ্চলের জনসংগঠন ও বারসিক’র পক্ষে কৃতি সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।

happy wheels 2