দর্জি কাজে সফল নার্গিস সুলতানার গল্প

বাহলুল করিম, সাতক্ষীরা থেকে

২১ বছর ধরে সফলতার সাথে দর্জি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া সরকার পাড়ার বাসিন্দা নার্গিস সুলতানা। সংসার চালানো থেকে শুরু করে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ করেন তার এই আয় থেকে। কাজের পাশাপাশি তিনি দর্জি প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন। এখন পাড়ার অনেক নারীই তার কাছ থেকে দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে সাবলম্বী হয়েছে। দর্জি কাজের পাশাপাশি সংসারের সমস্ত কাজ করেন একা হাতে। তবুও থেমে নেই তাঁর কাজ, থেমে নেই তার পথচলা। পাড়ার অনেক মানুষের পোশাক তৈরির কারিগর হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন তিনি। ভালো কাজের জন্য পাড়ার সমস্ত অর্ডার পান তিনি। তার সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় এক একটি পেশাক।

নার্গিস সুলতানা পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ছোট। বাবা দ্বিতীয় বিয়ের পর যখন তার মাকে দেখতেন না তখন মা জীবিকার তাগিদে টেইলার্সে কাজ শুরু করেন। হঠাৎ তার এক ভাই অসুস্থ হয়ে মারা যায়। এরপর বড় বোন হারিয়ে গেলে মা টেইলার্সের কাজ ছেড়ে দেন। তারপর মা সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসে রান্নার কাজ নিলেন। তখন থেকেই নার্গিস মায়ের কাজে সাহায্য করতেন।

Nargis Sultana 1

নার্গিস সুলতানা সাত বছর বয়সে সাতক্ষীরা সদরের সিলভার জুবলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শুরু হয় তার শিক্ষা জীবন। এখান থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরও পড়ালেখার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল তার। পরবর্তীতে সংসার চালিয়ে আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বিয়ের পর মা মাতৃসদনে কাজ নেন।

নার্গিস সুলতানা ১৯৯৭ সালে মহিলা অধিদপ্তরে দর্জি কাজের প্রশিক্ষণ নেন। এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে পরিবারের সকলের পোশাক তৈরি করে দিতেন। ২০০০ সালে তার ঘর আলো করে একটি মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। তখন থেকে প্রতিবেশি এক ভাবির সহযোগিতায় দর্জি কাজের অর্ডার পেতে থাকেন। এভাবেই শুরু হয় তার উপার্জন। সংসার খরচ ও মেয়েকে মানুষ করার যাবতীয় খরচ তার এই আয় থেকেই চলতো। স্বামী এক দিন কাজ করলে তিনদিন কাজ করতেন না।

মেয়ে একটু বড় হলেই তিনি শ্বশুর বাড়ি চলে আসেন। তখন থেকেই তার কষ্টের দিন শুরু হয়। তিনি হতদরিদ্র পরিবারের হওয়ায় শ্বাশুড়ি ও ননদ কেউ তাকে বউমা বলে মেনে নেয়নি। সারাদিনের সংসারের কাজ শেষে রাতের বেলা দর্জি কাজ করেন। ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে তিনি রাতের বেলা খুব কষ্ট করে দর্জি কাজ করতেন। পাঁচ বছর বয়সে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেন। এরপর মেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব তার উপর গিয়ে পড়ে।

পরে মেয়েকে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। বর্তমানে তার মেয়েটি দশম শ্রেণিতে পড়ে। শুরু থেকেই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন এই দর্জি কাজ করে। সকলের আবদার মেটাতে ঈদের সময় আত্মীয় স্বজনদের জামাকাপড়ও কিনে দেন।

Nargis Sultana 2

নার্গিস সুলতানা নিজে কাজ করার পাশাপাশি তিনি ১৫ জন নারীকে দর্জি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন অনেকেই দর্জি কাজ করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তার কাছে আশপাশের মানুষ আসে দর্জি কাজ শিখতে। তিনি তাদেরকে খুবই যত্নসহকারে কাজ শেখান।

প্রশিক্ষণ নিয়ে সাবলম্বী সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুরের বাসিন্দা জয়গুন বেগম বলেন, “নার্গিস আপার কাছে দর্জি কাজ শিখে অল্প দিনেই আমি সব কাজ ভালোভাবে শিখতে পেরেছি। তিনি খুব যত্নসহকারে আমাকে কাজ দেখিয়ে দিতেন। কোন কাজ বুঝতে না পারলে তিনি সেটা বারবার দেখিয়ে দিতেন। এখন আমি সংসারের খরচ চালাতে পারি। বাচ্চাদের ছোট-খাট আবদার মেটাতে পারি।”

এ ব্যাপারে মৃগীডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা রেশমা খাতুন বলেন, “আমি নার্গিস ভাবির পাশের বাড়ি ভাড়া থাকতাম। প্রথমে ভাবির কাছ থেকে কাজ করে নিতাম। মহিলা সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েও আমি ভাল কাজ শিখতে পারিনি। তাই ভাবির কাছ থেকে কাজ শিখি। কোন বিষয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করলেও তিনি বিরক্ত হন না। আমাকে অনেক যতœসহকারে সব কাজ শিখিয়েছেন। কাজ শেখানোর বিনিময়ে তিনি আমার কাছ থেকে কোন পারিশ্রমিক নেননি। বর্তমানে নিজের পোশাকসহ পরিবারের সব পোশাক তৈরি করতে পারি।”

একান্ত আলাপকালে নার্গিস সুলতান বলেন, “আমার মা আগে সেলাই কাজ করতেন। যখন মা কাজ ছেড়ে দেন তখন সেলাই মেশিনটা আমাকে দিয়েছিল। তখন থেকেই আমি সবাইকে বিনামূল্যে কাজ শিখিয়েছি। দর্জি কাজ করতে আমার ভালো লাগে। এক সময় সমিতি থেকে টাকা ঋণ নিয়ে সংসারে জন্য চাল কিনেছি। এই টাকা দর্জি কাজ করে পরিশোধ করেছি। আর যে টাকা থাকতো তা দিয়ে বাজার খরচ চলতো।” তিনি আরও বলেন, “দুঃসময়ে আমার চলার পথের সঙ্গী ছিল এই দর্জি কাজ। দর্জি কাজ করেই আজ আমি সফল। বর্তমানে সংসার খরচসহ মেয়ের লেখাপড়ার খরচ নিজেই চালাতে পারি। এজন্য আমাকে কারও দারস্থ হতে হয় না।”

নার্গিস সুলতানা বলেন, “প্রথমে আমি অল্প কাজ পারতাম। বর্তমানে নারী ও বাচ্চাদের যে কোন ধরণের পোশাক তৈরি করতে পারি। এখন কোন কোন দিন ৪০০-৫০০ টাকা আবার কোন কোন দিন ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। এভাবে মাসে প্রায় সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা আয় হয়। আশপাশের প্রতিবেশি ও মেসের মেয়েরা কাজ নিয়ে আসে। তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজনদের কাজও নিয়ে আসে।”

happy wheels 2

Comments