একটি জীবনের নাম ময়েজ উদ্দিন

রাজশাহী থেকে রাফি আহমেদ

মুক্ত বাতাস আর শিক্ষার কোলাহলে পরিপূর্ণ শহর রাজশাহী।  প্রতিদিনের সুর্যোদয়ের সাথেই শুরু হয় প্রাণবন্ত এই সবুজ শহরের বসবাসরত মানুষের জীবন। রংবাহারি মানুষের রংবাহারি জীবনযাপন।  ধনী-দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের নগরী এই রাজশাহী।  গতানুগতিক চলার মাঝে হাজারো জীবনের ভিড়ে একটি জীবনের নাম ময়েজ উদ্দিন। এক বীর যোদ্ধা। জীবন যুদ্ধের এক বীর তিনি। শহরের পার্শবর্তী দারুসা নামক এলাকায় তার বসবাস। পেশায় তিনি একজন রিকশা চালক। পরনে তার আধঘামা হাফহাতা গেঞ্জী ও লুংগি। বেশ উজ্জ্বল হাসি হাসি ক্লান্তিভরা চেহারা তার।  দুই হাতের আংগুলের ফাকে জলন্ত একটি বিড়ি নিয়ে সে  সজোর গলায়  ডাক দেয়,  মামা কোথায় যাবেন? আসেন রিক্সায় উঠে বসেন।

IMG_20180924_165052

সবাই শুধু তার দিকে তাকায় আর মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। বোধগম্য হয় না এর কারণ। কেউ কেউ রিক্সায় যাবার উদ্দেশ্য নিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে তবুও তার রিক্সায় কেউ উঠতে চায় না। এর কারণ হল ময়েজ উদ্দিন এর একটি পা নেই। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চারঘাট উপজেলা পরিষদের রাস্তায় মালবাহী একটি ট্রাক তার একটি পা কেড়ে নিয়েছে। ১৪ মাস হাসপাতালে থাকার পর বাড়ি ফিরতে পারে ময়েজ উদ্দিন। হাসপাতাল থেকে তাকে একটি প্লাস্টিকের নকল পা লাগিয়ে দিয়েছে। সেই পা দিয়েই তার পথচলা শুরু নতুন করে। আগে তিনি অটোরিকশা চালাতন। চিকিৎসার কারণে সেই অটো টিকেও বেঁচে দিতে হয়েছে তাকে। এখন তিনি যে রিক্সাটি চালান সেটি ঋণ করে তাকে তার স্ত্রী কিনে দিয়েছেন। ময়েজ উদ্দিনের ছোট্ট পরিবার। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ৪ জনের সংসার তাদের। তার ছেলে রাজশাহীর কোর্ট কলেজে এইচএসসি ১ম বর্ষের ছাত্র, আর মেয়েটা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ৩য় শ্রেণীতে পড়ে। তার স্ত্রী একজন গৃহীনি।

এক সড়ক দুর্ঘটনা ময়েজ উদ্দিন কে পঙ্গু করেছে ঠিকই, কিন্তু তার মনোবল কে পঙ্গু করতে পারেনি। ময়েজ উদ্দিন ভিক্ষাবৃত্তি পছন্দ করেন না। তিনি ভিক্ষা করতে চান না। তিনি তার সাধ্যমতে পরিশ্রম করেই রোজগার করেন। ময়েজ উদ্দিন কারো অনুগ্রহে বাঁচতে রাজী নন। প্রতিদিন তিনি যা উপার্জন করে ঘরে নিয়ে যায় তাতেই তার সংসার চলে। ছেলেমেয়েদের কে উচ্চশিক্ষিত করতে চান ময়েজ উদ্দিন। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চান সমাজে। জীবনযুদ্ধে তিনি পরাজিত নন। লড়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত।  প্রতিদিন ভোরে তিনি রিক্সা নিয়ে শহরে আসেন রোজগারের উদ্দেশ্যে কিন্তু শহরের শিক্ষিত মানুষ তার পঙ্গুত্বের জন্য তার রিক্সায় ওঠেন না। সারাদিন হাতে গোণা কয়েকটা যাত্রী বহন করতে পান তিনি। তাতেই তিনি সুখী।  তার আকাঙ্ক্ষা অনেক সৎ,  তার চাহিদা অনেক স্বল্প, তার ইচ্ছা সীমিত।  তবুও সুশীল সমাজ তার সম্মান করে না। তার দিকে সৌহার্দ্যের একটি বাড়িয়ে দিতে চায় না। আমাদের চারিপাশে এরকম অনেক ময়েজ উদ্দিন আছেন। যারা করুণা চান না শুধু চান একটু সৌহার্দ্য একটু সহযোগিতা। মানুষ মানুষের জন্য। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষের পরম দায়িত্ব ও কর্তব্য।

 

happy wheels 2

Comments