আমরা পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেকেরও কম মজুরি পাই

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

আমাদের দেশের শ্রম বাজারে দীর্ঘ দিন যাবত নারী ও পুরুষের মজুরি বৈষম্যে চলে আসছে। যে নারীরা কৃষি কাজের সূচনা করেছিল সেই নারীরাই কৃষি ক্ষেত্রে যেমন মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তেমনি ইটের ভাটা, শুটকির চাতাল, ধানের মিল চাতালসহ অন্যান্য কাজ করতে গিয়েও তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি সরেজমিন চলনবিল এলাকার শুটকি মাছের চাতালগুলো পরিদর্শনকালে জানা যায়, একজন নারী শ্রমিক একজন পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেকেরও কম পারিশ্রমিক পাচ্ছেন।

২৪ অক্টোবর বুধবার। দুপুর বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। নাটোরের বনপাড়া-সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল সড়কের মহিষলুটি এলাকায় রাস্তার পাশের শুটকী চাতালে অস্থায়ী তাবু জাতীয় ঘরে সকালের খাবার খাচ্ছিলেন নারী শুটকি শ্রমিক আসমা ও মাজেদা খাতুন। পাশেই চাতাল মালিক দিলবার হোসেন ও তার ছেলেও খেয়ে নিলেন সকালের খাবার। ভোর থেকে সারা দিনই শুটকির চাতালে কাজ করতে হয় নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের। নারী ও পুরুষের কাজে সামান্য কম বেশি থাকলেও পারিশ্রমিকের বেলায় একজন নারী একজন পুরুষের অর্ধেকেরও কম পারিশ্রমিক পান।

nari 13
আসমা খাতুনের বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার ললিয়াকান্দি গ্রামে। স্বামী জোনাব আলী গত হয়েছেন অনেক দিন আগেই। তিন চার বছর যাবত শুটকি মৌসুমে শুটকির চাতালে কাজ করেন তিনি। আসমা বলেন, ‘অভাবের সংসারে বসে না থেকে যা কিছু উপার্জন করি তাই লাভ। স্বামী নাই। বড় ছেলে মালেক অপারেশন করানো। মাঠে কাজ করতে পারে না। মাছের সময় মাছের আড়তে টুক টাক কাম করে। ছোট ছেলে রবিউল পরের বাড়ি হাল আবাদের কাম করে। নিজেদের জায়গা জমি নাই। দুই ছেলে এক বৌমা নাতি ও আমি এ পাঁচ জনের সংসার। অনেক খরচ। তাই বাড়তি কিছু আয় করার জন্য শুটকির চাতালে কাজ করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সকাল ৭ টা থেকে বেলা ডোবা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিনিময়ে পারিশ্রমিক পাই ১শ’ ২০ টাকা। শুটকির চাতালের রান্না, মাছ ধোয়া, লবণ মেশানো, বানায় তুলে দেওয়া, মাছ উল্টে দেওয়া ও বাছাইয়ের কাজ করতে হয়। পুরুষ শ্রমিকেরা অতিরিক্ত কাজের মধ্যে ভোরে আড়ত থেকে চাতালে মাছ নিয়ে আসেন। একজন পুরুষ শ্রমিক প্রতিদিন ৩শ’ টাকা পারিশ্রমিক পেলেও আমরা তাদের অর্ধেকেরও কম পারিশ্রমিক পাই।’

লীলয়াকান্দি গ্রামের মাজেদা খাতুন (৫০) বলেন, ‘বারো বছর বয়সে বিয়ে হলে স্বামীর ঘরে চলে আসি। পর পর তিন ছেলে এক মেয়ে এ চার সন্তানের জন্মের পর স্বামী হানেফ আলী মান্নান নগরের পাশর্^বর্তী মহাশৈল গ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। আমার এবং ছেলে মেয়েদের ভরণ পোষণ দিতেন না তিনি। কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে ছেলে মেয়েদের বড় করি। হামিদা, বুলবুলী ও সোহাগী নামক তিন মেয়েকে বিয়ে দেই। ছেলে মাঠে কাজ করে। পৃথক সংসার তার। আমি একা। নিজে উপার্জন করে খেতে পরতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যখন যে কাজ পাই সেটিই করি। বিবাহিত মেয়েরা মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসে। আশি^ন থেকে অগ্রহায়ণ মাস শুটকি চাতালে কাজ করি। পুরুষ শ্রমিকদের প্রায় সমান কাজ করলেও তাদের অর্ধেকের চেয়েও কম পারিশ্রমিক পাই। একজন পুরুষ শ্রমিক প্রতিদিন ৩শ’ টাকা পারিশ্রমিক পেলেও আমরা পাই ১শ’ ২০ টাকা।

nari-12
ললিয়া কান্দি গ্রামের মৃত দবির প্রাং এর স্ত্রী মইফুল (৬০) বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর আগে আমার স্বামী মারা যায়। চার মেয়ে এক ছেলে আমার। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এখন ছেলে, ছেলে বৌ, এক নাতি, দই নাতিন ও আমি এ ৬ জন এক অন্নে আছি। জমা জমি নেই। ছেলে মাঠের শ্রমিকের কাজ করে। একার উপার্জনে সংসার চালানো তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পরে। তাই একটু বাড়তি আয়ের আশায় শুটকি মাছের মৌসুমে চাতালে কাজ করি। সারা দিন কাজ করে ১শ’ ২০ টাকা পারিশ্রমিক পাই। পুরুষ শ্রমিকেরা পায় ৩শ’ টাকা করে।’

আমেনা খাতুন (৫০) এর স্বামী খোরশেদ আলী বার্ধক্যজনিত কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। ঘরে শুয়ে বসেই দিন কাটে তাঁর। দুই ছেলে দুই মেয়ে আমেনার। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ছেলে রাশেদুলের পৃথক সংসার। আমেনা বলেন, ‘আমি, বড় ছেলে সাইদুল, ছেলে বৌ শাহিদা, সাইদুলের এক ছেলে, দুই মেয়ে ও আমার বৃদ্ধ স্বামী এ সাতজন এক অন্নে খাই। কোন জমা জমি নাই। এক ছেলে আর কত কষ্ট করবে। এত বড় সংসার চালাতে অনেক টাকা খরচ। তাই ছেলেকে কিছুটা সাহায্য করার জন্যই শুটকির মৌসুমে চাতালের কাজ করি। দুই তিন মাস এ কাজ করা যায়। প্রায় সমান কাজ করলেও একজন পুরুষের তুলনায় খুব কম পারিশ্রমিক পাই।’

nari-15
চাতাল মালিক দেলবার হোসেন জানান, পুরুষ শ্রমিকেরা ভোর হওয়ার সাথে সাথে মাছের আড়তে চলে যায়। মাছ কেনায় সহায়তা করেন। মাছ নিয়ে আসে চাতালে। এরপর চাতালে কাজ শুরু করে তারা। এজন্য পুরুষ শ্রমিককে বেশি পারিশ্রমিক দিতে হয়। তাছাড়া এ বছর ব্যবসার অবস্থাও ভালো নয়। তাই ইচ্ছা থাকলেও নারী শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

happy wheels 2

Comments