সবুজ অর্থনীতি: অর্থনীতিকে সবুজ নাকি সবুজকে পণ্যে রূপান্তর?

সিলভানুস লামিন

বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা এ বিশ্বের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনের জন্য উন্নয়ন পণ্ডিত, বিজ্ঞানী এবং নীতিনির্ধারকগণ “উন্নয়ন”, “স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন” এবং অতিসাম্প্রতিক “সবুজ অর্থনীতি” অনেক প্রত্যয়ই ব্যবহার করে কর্মসূচি-উদ্যোগ-গবেষণা-উদ্ভাবন পরিচালনা করেছেন, করছেন বিশ্বের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধনের জন্য। কিন্তু এত উন্নয়ন উদ্যোগ-তত্ত্ব-মডেল উদ্ভাবন ও বাস্তায়নের পরও সামগ্রিক বিবেচনায় বিশ্বের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হয়নি; বরং সম্পদ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর হাতে। যেকোন সময়ের তুলনায় বর্তমান বিশ্বে বৈষম্যের হার অনেক বেশি। ফলশ্রুতিতে হতদরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের হার বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ, উন্নয়ন দুর্যোগ এবং বিশ্বকে অতি যান্ত্রিক পরীক্ষণের কারণে বিশ্বে বৈষম্য ও দারিদ্রতার হার বেড়েই চলেছে। উন্নয়ন প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জোরদার করার জন্য। অন্যদিকে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন আলোচনায় পরিবেশ-প্রতিবেশকে রক্ষা ও ভারসাম্য রেখে উন্নয়ন উদ্যোগ পরিচালনার ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর, বড্ড কঠিন! স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন ডিসকোর্সে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা বা ভারসাম্য রাখার বিষয়টি নথিতেই আবদ্ধ হয়েছে, কদাচিৎ বাস্তবে অনূদিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পরিবেশ বিপর্যয়সহ প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্তি ও বন উজাড়ের হার বেড়েই চলেছে। এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, বিগত ৮ হাজার বছরে বিশ্বের প্রায় ৪৫% বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে এর মধ্যে অধিকাংশই ধ্বংস হয়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেব অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ১৩ মিলিয়ন হেক্টর বনাঞ্চল হারিয়ে যাচ্ছে।

স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে আরও জোরদার এবং জলবায়ুজনিত সমস্যা সমাধানের জন্য গত কয়েকবছরে “সবুজ অর্থনীতি” নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। UNEP’র মতে, সবুজ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:

১) এটি কম গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে,
২) প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে,
৩) প্রবৃদ্ধি, আয় ও কর্মসংস্থান বাড়ায়,
৪) সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করে
৫) পরিবেশ ঝুঁকি হ্রাস করে।

অর্থ্যাৎ সবুজ অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি উন্নয়ন উদ্যোগ যেখানে সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে বিশ্বে নিত্যনতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে, যা সমাজে সাম্যতা নিশ্চিত করবে এবং পরিবেশ এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে না। মূলত তিনটি ধাপে সবুজ অর্থনীতি তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ধাপগুলো হলো:
১) কৃষি, বন, মৎস্য ও পানি সম্পদ খাতে বিনিয়োগ,
২) জ্বালানি ও সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পণ্য উৎপাদন, আবর্জনা, পরিবহন, নবায়নযোগ্য জ্বালানী, ভবন, পর্যটন এবং নগরায়নে বিনিয়োগ এবং
৩) নকশা বা মডেলিং, পরিবেশ তৈরি এবং অর্থায়ন। এই হলো সবুজ অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত রূপ।

উপরোক্ত রূপটি বিশ্লেষণ করে আমরা কী দেখতে পারি? কৃষি ও বন খাতে বিনিয়োগ করার অর্থ হচ্ছে দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের অধিকারকে ক্ষুন্ন করার শামিল। কারণ জৈব জ্বালানি, ইথানল ও জিএম প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকের ভূমি গ্রাস করবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে আদিবাসীরা তাদের জীবন-জীবিকা দিয়েই বনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে আসছেন তথাপি রেড (REDD=Reducing Emissions from Deforestation and Forest Degradation) প্রকল্পের মাধ্যমে আদিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশু সম্ভাবনা থাকে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমি মালিকদের বন সংরক্ষণ ও বনায়নের জন্য আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে কিন্তু আদিবাসীরা অনেক সময় তাদের ভূমির মালিকানা প্রমাণ (!) করতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই সুবিধা পাবে না। বরং রেড এর মাধ্যমে একক প্রজাতির বৃক্ষরোপণ “বনায়ন” হিসেবে বৈধতা পাওয়ায় ভূমিখেকো এবং বহুজাতিক কোম্পানি সহজে আদিবাসীদের ভূমি দখল করে একক প্রজাতির বনায়ন সূচনা করে আর্থিকভাবে লাভবান হবে। ফলশ্রুতিতে আদিবাসীদের ভূমি তো হরণ হবেই পাশাপাশি একক প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের কারণে প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্তির হার বৃদ্ধি পাবে। এতে করে সবুজ অর্থনীতি আর কি সবুজ থাকে? নাকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ‘সবুজ’ দিয়ে ব্যবসা করার বৈধতা দেওয়া হচ্ছে এবং ‘সবুজ’কে মুনাফা গ্রাসের প্রধান উপাদান হিসেবে গ্রহণ করার ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে?

রেড (REDD) এর মাধ্যমে তো উন্নত দেশগুলোকে ছাড়পত্রই দেওয়া হয়েছে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করার জন্য এবং কিয়োটো প্রটোকল অনুযায়ী তাদের নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে কার্বন ক্রেডিট ক্রয় করে। মজার বিষয় হচ্ছে, রেড (REDD) এর মাধ্যমে যে কার্বন ব্যবসা চলছে সেটাও নিয়ন্ত্রণ করছে বহুজাতিক কোম্পানি বা প্রভাবশালীরা। দরিদ্র, প্রান্তিক কৃষক কিংবা আদিবাসীরা এর সুফল লাভ করে না। এটাও দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সার্বজনীন সম্পদ তথা পরিবেশ, মাটি, বায়ু, বনের মূল্য পণ্যের মতো ডলারে মাপা হচ্ছে! অন্যদিকে সবুজ অর্থনীতির বিরোধীরা বলেছেন, সবুজ অর্থনীতি সবুজ কৃষি বা ক্ষুধার্তদের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে পারবে না। বরং এটি ভূমি, পানি, বীজ এবং প্রাণবৈচিত্র্যসহ কৃষি ও খাদ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হাতে ন্যস্ত করবে। ভূমি ও পানির মতো সম্পদ যখন বহুজাতিক কোম্পানির হাতে নিয়ন্ত্রিত হবে স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না, নিশ্চিত হবে না তাদের লোকায়ত জ্ঞাননির্ভর কৃষি অনুশীলন যা পরিবেশ ভারসাম্য রাখে এবং প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। অথচ সবুজ অর্থনীতির জন্য স্থানীয় কৃষকের সেই জ্ঞান ও অনূশীলনকে বিবেচনায় আনা জরুরি। এই ডিসকোর্সের সমালোচকরা বলেছেন, সবুজ অর্থনীতি একটি ব্যয়বহুল এবং সে ব্যয় নির্বাহ করা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সহজ নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে কী সম্ভব তার দেশের সব বাড়িতে সৌর বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া? কিংবা বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রচলন করার?

সবুজ অর্থনীতি অবশ্য একটি ভালো ধারণা এবং বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের জন্য আমাদের অর্থনীতি সবুজ করতে হবে। অর্থনীতিকে সবুজ করার ক্ষেত্রে যাতে ভূমি, মাটি, পানি সম্পদের ব্যবস্থাপনা কোন কর্পোরেট কোম্পানির হাতে নিয়ন্ত্রিত না হয় সেদিকে জোর দিতে হবে এবং রেডসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং আদিবাসীদের স্বাধীন, পূর্বানুমতি ও অবগত সম্মতি নিতে হবে। সবুজ অর্থনীতি উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রতিবছর বৈশ্বিক জিডিপির ২% তথা ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় ধরা হয়েছে। কিন্তু এই অর্থ কী পর্যাপ্ত? বৈশ্বিক সামরিক খাতে প্রতিবছর ১.৫৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মোট জিডিপির ১৬% স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে! এছাড়া সারাবিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানী খাতে প্রতিবছর ভর্তুকি হিসেবে মোট বৈশ্বিক জিডিপির ২% বরাদ্দ করা হয় অথচ সারাবিশ্বে সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দকৃত এই অর্থ কী কম নয়?

happy wheels 2

Comments