‘মানুষের সাথে প্রকৃতির সংযোগ ঘটাতে ছট্ পূজা’

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

ধর্মীয় আচার বা পার্বণ আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী তাঁদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। এর সাথে একদিকে যেমন জড়িয়ে আছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিশ্বাস, তেমনি অন্যদিকে প্রকৃতির উপর মানুষের নির্ভরশীলতা। সংস্কৃতি গড়ে উঠে আমাদের প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। কারণ এই ছট্ পূজা বা সূর্য ষষ্ঠী পূজায় ব্যবহৃত সকল উপকরণ পাওয়া যায় প্রকৃতি থেকে। যে সকল সম্প্রদায় এই পূজা পালন করেন তাঁরা পূজায় ব্যবহৃত সকল উপকরণ সংরক্ষণ করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রবিদাস সম্প্রদায় অন্যতম। তাঁরা গত ১৩ ও ১৪ নভেম্বরে এই পূজা উৎসব পালন করেন।

ছট্ পূজার ইতিহাস
জানা যায়, ভারতবর্ষের আদি নিবাসী হিন্দী ভাষাভাষির জনগোষ্ঠী এই পূজা প্রথম প্রচলন করেন। তাঁদেরই বংশ পরম্পরায় যারা বাংলাদেশে বসবাস করছেন, তাঁরা এখনো এই সংস্কৃতি বা বিশ্বাস ধরে রেখেছেন। ছট্ পূজা রবিদাস সম্প্রদায়ের এক বিশেষ ধরণের পূজা। সূর্য দেবতাকে তুষ্ট করতেই এই পূজা করা হয়।

কেন এই পূজা করা হয়
সূর্য হলো শক্তির দেবতা। আর ছট্ মানে ছটা। তাই সূর্য থেকে আসা আলোর ছটায় আছে অফুরন্ত শক্তি। এই শক্তির সাহায্যেই মানুষ বেড়ে উঠে, ফসল আবাদ করে। আবার পানির উৎস স্থলগুলোও রক্ষা পায়। যে পানির সাহায্যে মানুষ চাষাবাদ করে, পানি পান করে জীবন বাঁচায়। তাই সূর্য পূজা করলে একদিকে যেমন মানুষের খাওয়ার অভাব থাকবেনা আবার অন্যদিকে জীবনীশক্তি বাড়বে এই বিশ্বাসে রবিদাস সম্প্রদায় ছট্ পূজা করেন।

কখন করা হয়
কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপাবলী পালনের ষষ্ঠ দিনে এই পূজা করা হয়। একারণেও এই পূজাকে ষষ্ঠী পূজা বলা হয়। অর্থাৎ শুক্লা ষষ্ঠীর দিনে এই পূজা করা হয়।

পূজায় ব্যবহৃত উপকর
সূর্য ষষ্ঠী পূজার বিশেষ উপকরণ হলো আখ আর নারিকেল। এছাড়া এ সময়ের বিভিন্ন ফল, সব্জী, ফুল, আতব চালের গুড়া, সরিষার তেল, গুড়, আদা, মিষ্টি সজ, মাটির ঘট, প্রদীপ, বাঁশের কুলা ও খলই, কলা পাতা, ধান, দূর্বা, আম পল্লব, হলুদ গাছ, হরিতকি, সিঁদুর, বেল পাতা, পান, সুপারি, লাল রঙের গামছা, নতুন কাপড় ইত্যাদি।

কিভাবে এই পূজা করা হয়
কার্ত্তিক মাসে যে দিন কালী পূজা হবে সে দিন থেকে ব্রত পালনকারীকে নিরামিষ খাবার খেয়ে থাকতে হয়ে। অর্থাৎ মাছ বা মাংস খেতে পারেনা। ৫ম দিনে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়িতে গোবর ছিটিয়ে শুদ্ধ করতে হয়। তারপর স্নান সেরে মুগ ডাল আর দেশী লাউ দিয়ে রান্না করা তরকারী দিয়ে ভাত খায়। তবে রান্না করা হয়ে গেলে ভাত তরকারী প্রথমেই তুলে রাখতে হয় রাতে খাবারের জন্য। ব্রত পালনকারী যে ঘরে থাকবে সেই ঘরে অন্য কেউ থাকতে বা কোনো খাবার খেতে পারেনা।

20181113_165704
গভীর রাতে বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন সেই ব্রত পালনকারী নতুন শাড়ি, গয়না ও অন্যান্য উপাদানসহ কপাল ভর্ত্তি সিঁদুর দিয়ে সাজে এবং এভাবে থেকে সে সকালে তুলে রাখা খাবার খায়। খাবারের সময় কারো সাথে কোনো কথা বলা যায়না। অথবা কেউ যদি তার নাম ধরে ডাকে তবে সে আর ভাত খেতে পারেনা। পূজাও করতে পারেনা।

খাওয়া শেষ হলে নতুন কাপড়টি তুলে রেখে দিতে হয় পরের দিনের জন্য। পরের দিন সকালে উঠে স্নান করে পূজার যোগাড় করে। প্রথমে কুড়ানো নারিকেল, নারিকেলের জল, আর গুড় দিয়ে আঠালো রস বা সিরা তৈরি করে। তারপর এতে চালের গুড়া মিশিয়ে এক ধরণের নকশী পিঠা তৈরি করে, যা এই পূজার একটি উল্লেখ যোগ্য উপাদান। এরপর পূজার জন্য সংগ্রহ করা সকল ধরণের ফল কেটে কলাপাতায় সাজিয়ে রাখে। পিঠাগুলো বাঁশের খলইতে এবং অন্যান্য উপাদান কুলায় করে সাজিয়ে নিতে হয়। তারপর সেগুলো লাল গামছা দিয়ে ঢেকে উঠোনে আল্পনা আঁকা জায়গায় কিছুক্ষণ রেখে সেখানে নারীরা বসে গীত গায়।

20181113_170956
তারপর সন্ধ্যের ঠিক আগে অর্থাৎ সূর্য ডোবার আগ মুহুর্তে নদীর পাড়ে এগুলো নিয়ে যায়। নদীর পাড়ে যেখানে জল আর বালির সংমিশ্রণ সেখানে আখ গাছের অগ্রভাগের অংশটুকু পুঁতে দিয়ে তার সামনে ঘট রেখে ধূপ জ্বালায়। এবং নাভি পর্যন্ত নদীর জলে নেমে গঙ্গা মায়ের উদ্যেশ্যে নদীতে পান, সুপারি আর ফুল দেয়। তারপর আবার গীত গেয়ে সমস্ত উপকরণ বাড়ি এনে এভাবেই সেগুলো রেখে দিতে হয়।

সারা রাত ধরে আবার পরের দিনের যোগাড় করতে হয় একই নিয়মে। তারপর খুব ভোরে নদীতে চলে যেতে হয়। আগের দিন সন্ধ্যায় যেসব নিয়ম পালন করা হয়েছিল, ব্রতীরা সে সব আবার করে। সূর্য উঠার সাথে সাথে নদীতে ভোগ অর্পণ করতে হয়। তারপর ঘটের জল, আদা আর গুড় দিয়ে সকল ব্রতীদের উপোস ভাঙতে হয়।
বাড়িতে এসে চলে সিঁদুর খেলা এবং প্রসাদ খাওয়া। ছোট বড় সকলে মিলে এক সাথে হৈচৈ করে আনন্দ করে। নারীরা হয়তো উপোস করে কিন্তু পূজার অন্যান্য কাজে সহায়তা করে বাড়ির পুরুষেরা। এই পূজায় কোনো মূর্তি লাগেনা, ঘটে পূজা করা হয়। পূজার শেষ দিন সকল ব্রতীকেই মাছ অথবা মাংস দিয়ে ভাত খেতে হয়। এরপর শেষ হয় এ বছরের মতো এই পূজার আয়োজন।

20181113_171313
যদিও কিছু আচার পালনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, কিন্তু এই পূজার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সাথে প্রকৃতির সংযোগ। নদীর জলকে পূজা করে বলে তাঁরা নদী দূষণ করেনা। প্রকৃতির যেসব উপাদান এই পূজায় ব্যবহার করা হয় এগুলো গুরুত্ব পায় বলে মানুষ সংরক্ষণ করে। মানুষের সাথে প্রাকৃতিক উপাদানের সম্পর্কই টিকিয়ে রেখেছে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য। তাই প্রাণবৈচিত্র্য যত বেশি সমৃদ্ধ হবে প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক তত বেশি নিবিড় হবে।
তথ্য সূত্রÑ লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের রবিদাস সম্প্রদায়।

happy wheels 2

Comments