আমার বাড়িকে একটি কৃষিখামারে পরিণত করেছি: অল্পনা রাণী

অল্পনা রাণী মিস্ত্রী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট গ্রামে বাস করেন পেশায় তিনি একজন কৃষাণী তিনি দীর্ঘদিন যাব স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকূলীয় কৃষি প্রতিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন জৈব পদ্ধতিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষাবাদ, বীজ সংরক্ষণ সম্প্রসারণ, সব ধরনের ঔষধি গাছের বনায়ন, ব্যবহার সংAlpona (54)রক্ষণ, প্রাণী সম্পদ সংরক্ষণ সম্প্রসারণ, জৈব ভার্মি কম্পোষ্ট ৎপাদন, প্রশিক্ষণ ব্যবহার, অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং হাজল পরিবেশবান্ধব বন্ধু চুলার ব্যবহার প্রশিক্ষণে সহায়তা, দুর্যোগকালীন খাদ্য সংকট নিরসনে শুটকি সংরক্ষণ, ব্যবহার স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধকরণ, পুকুরে স্থানীয় জাতের ৎস্য চাষ এর মাধ্যমে সংরক্ষণ করেন উল্লেখ, ২০১৪ সালে সমন্বিত কৃষি চর্চায় অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী অল্পনা রানী উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার লাভ করেন এছাড়াও কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ১৪১৯ (ব্রোঞ্জ পদক) লাভ করেন তিনি এমন একটি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন যা উপজেলার একটি সফল মডেল হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত বারসিকনিউজ.কম এর সাথে আলাপচারিতায় অল্পনা রাণী তাঁর দীর্ঘদিনের কাজ, জীবন সংগ্রাম, কৃষিতে সাফল্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্বীকৃতি এবং ভবিষ্যত স্বপ্ন ইত্যাদি জানিয়েছেন পাঠকদের জন্য এই আলাপচারিতার চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন বারসিক রামকৃষ্ণ জোয়ারদার এবং মননজয় মন্ডল

 

বারসিকনিউজ.কম: কেমন আছেন?

অল্পনা রাণী: ভালো আছি।

বারসিকনিউজ.কম: কি করছেন?

অল্পনা রাণী: এই তো কাজ করছি।

বারসিকনিউজ.কম: আপনার স্থায়িত্বশীল কৃষিকাজ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। কৃষিকাজের আগে কেমন ছিলো আপনার জীবন-জীবিকা?

অল্পনা রাণী: বিয়ের কয়েক বছর পর আমি এবং আমার স্বামী মিলে পরিকল্পনা করলাম বসতভিটায় বারোমাস সবজি চাষ এবং প্রতিবছর ২-৩ বিঘা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আমন ধান চাষ করার। সেখান থেকে বসতভিটায় স্বামীর সহযোগিতায় মৌসুমভিত্তিক আলু, টমেটো, বেগুন, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, ডাটাশাক, ওলকপি, ফুলকপি, বাধাকপি, মুলা, উচ্ছে, শিম, লালশাক, পালংশাক, চালকুমড়া, লাউ, কচুরমুখি, পুইশাক, শসা, মরিচ, পেয়াজ, রসুন, হলুদ ও সরিষা ইত্যাদি সবজি চাষ করি। আমন মৌসুমে ৫-৭ বিঘা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করি। এভাবে বৈচিত্র্যময় শাকসবজি চাষাবাদসহ সমন্বিত কৃষিখামার গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আমি সংসারের অভাব দূর করতে সক্ষম হই। সংসার জীবনের শুরুটা ছিল অনেক কষ্টের। সংসারে অর্থের সমস্যা ছিল। অনেক অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে জীবন। তখন নুন আনতে পানতা ফুরায় এই অবস্থা।

বারসিকনিউজ.কম: গত একবছরের মধ্যে আপনার নিজের জীবনের সবচে’ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কথা কি বলবেন?

অল্পনা রাণী: বিগত একবছরে আমার জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে। আমার জীবনের অনেক বড় পরিবর্তন হল কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ১৪১৯ (ব্রোঞ্জ পদক) লাভ। এছাড়াও বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা লাভ। আমি এলাকার নারীদের নিয়ে ধূমঘাট শাপলা নারী উন্নয়ন সংগঠন গড়ে তুলেছি। যার প্রধান দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমার জীবনের আরো বড় একটি ঘটনা আমার বাড়িতে উপজেলা প্রেসক্লাবের সাংবাদিক, চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কৃষি কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাসহ পরিদর্শন করেছেন।

বারসিকনিউজ.কম: আপনার এই সময়ের ভাবনা ও উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাই। কিছু বলবেন কি?

অল্পনা রাণী: আমি অনেক কষ্ট করে সফলতার মুখ দেখেছি। কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেকের বাড়িকে একটি কৃষি খামার গড়ে তুলতে হবে। আমি আমার বাড়িতে জৈব পদ্ধতিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষাবাদ, বীজ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ, সব ধরনের ঔষধি গাছের বনায়ন গড়ে তুলেছি। এছাড়া প্রাণী সম্পদ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ, জৈব ও ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদন, প্রশিক্ষণ ও ব্যবহার, অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজও করছি। অন্যদিকে হাজল ও পরিবেশবান্ধব বন্ধু চুলার ব্যবহার ও প্রশিক্ষণে সহায়তা , দুর্যোগকালীন খাদ্য সংকট নিরসনে শুটকি সংরক্ষণ, ব্যবহার ও স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধকরণ এ কাজ করছি। মাছের জন্য পুকুরে স্থানীয় জাতের মাছ চাষ করি।

বারসিকনিউজ.কম: কেন আপনি স্থায়িত্বশীল কৃষিসহ পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন?

অল্পনা রাণী: আমরা জানি বাংলাদেশ কৃষির উপর টিকে আছে। তবে আগের দিনের মত কৃষি চর্চা দরকার। কৃষকেরা যাতে বীজ রাখতে পারেন সেই ধরনের কাজ করতে হবে। গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান এই চিত্র আগে দেখা যেত। এখন আমি মনে করি সেইরকম পরিবেশ হলে মানুষের অভাব ও কোন দুঃখ হতাশা থাকত না। আমি মনে করি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সব ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা দরকার। কারণ পরিবেশ ও প্রকৃতি বিপদগ্রস্ত হলে আমরাও বিপদগ্রস্ত হবো।

বারসিকনিউজ.কম: এই যে পরিবর্তনের কথাগুলো বললেন সেগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য আপনাদের কোন পরামর্শ আছে? হলে কি ধরনের?

অল্পনা রাণী: কৃষি টিকে না থাকলে আমরা টিকে থাকব না। আমাদের সবাইকে একযোগে কৃষির জন্য কাজ করতে হবে। বিষমুক্ত সবজি চাষ ও কৃষি কাজ করতে হবে। আমাদের পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। জৈব সার ও কেচো সার ব্যবহার করতে হবে। আমাদের বাঁচার জন্য সব ধরনের গাছপালা ও উদ্ভিদ ও প্রাণীকে বাঁচাতে হবে। দেশীয় হাঁস-মুরগি গরু, ছাগল, ভেড়া পালন করতে হবে।

বারসিকনিউজ.কম: টিকিয়ে রাখার জন্য আপনার কি কোন ভূমিকা আছে বলে মনে করেন? কি ধরনের ভূমিকা?

অল্পনা রাণী: আমি মনে করি সমাজকে উন্নত ও দেশকে উন্নয়ন করাতে গেলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে নারীকে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা আমরা পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারলে সংসারের উন্নয়ন হবে। পুরুষেরা বাইরে থেকে আয় করলে আমরা ঘরে বসে আয় এবং বাড়ির কৃষিকাজ করে আয় করতে পারি।

বারসিকনিউজ.কম: বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী এবং বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?

অল্পনা রাণী:আমার এ কাজের পেছনে পরিবারের সমর্থন সবসময়ই পেয়েছি। পরিবারের উৎসাহে আজ আমি এই কাজে সফলতা লাভ করেছি। এছাড়াও প্রতিবেশীর সাথেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে আমরা। আমরা মিলে মিশে থাকি। একে অপরের সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করি। বন্ধু বান্ধব আমাকে সবক্ষেত্রে সহায়তা করে, ভালো পরামর্শ প্রদান করে, সব কাজে সহায়তা করে, উপকার করে। আমি চরারচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। সেখানে সকলেই আমাকে শ্রদ্ধা করে, সকলেই ভালোবাসে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আমাকে ভালোবাসেন এবং সম্মান করেন। আমি তাদের বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে সবকিছু করি। তাদের সাথে আলোচনা করে কাজ করি। সরকারি ও বেসরকারি অফিসারদের সাথে এখন আমার ভালো পরিচিতি তৈরি হয়েছে।

বারসিকনিউজ.কম: আপনার ভবিষ্যত স্বপ্ন বা ইচ্ছার কথা কি বলবেন?

অল্পনা রাণী: আমি যেভাবে আমার কৃষি বাড়ি তৈরি করেছি সেভাবেই আরো কৃষি বাড়ি তৈরি করতে চাই। আমার দেখাদেখি অনেকেই বাড়িটাকে সাজানোর চেষ্টা করে চলেছেন। আমার সহযোগিতায় ২টি কৃষি বাড়ি তৈরি হয়েছে। ঠিক আমার বাড়ির মত! আমি চাই শ্যামনগরের প্রতিটি বাড়ি যেন আমার কৃষি বাড়ির মত হয়।

 

happy wheels 2