সাম্প্রতিক পোস্ট

প্রাকৃতিক উপাদানে চা তৈরির সহযোগিতা পেল রুপা আক্তার

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

প্রায় ২২ বছর আগে লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের রুপা আক্তারের বিয়ে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী রামপুর গ্রামের কৃষক মো. সাত্তার মিয়ার সাথে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছিল তাদের সংসার। বড় ছেলেটি জন্মের পর রুপা আক্তারের নিঃসন্তান বোন ছেলেটিকে নিজের কাছে নিয়ে যায়। নিজের ছেলের মতোই মানুষ করেছে তাকে। মেয়েটি লক্ষ্মীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে একই প্রতিষ্ঠানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।

স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে রুপাকে দুই সন্তানসহ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় প্রায় ১৩ বছর আগে। এরপর তিনি চলে আসেন লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামে তাঁর বোনের বাড়িতে। বোন ঢাকার কোনো একটি গার্মেন্ট্স এ কাজ করে। নিজের সম্পদ বলতে কোনো কিছুই নেই রুপার। বোনের রেখে যাওয়া ঘরেই এখন তিনি ছেলে মেয়েকে নিয়ে থাকেন। স্বামী আর কোনো খোঁজ নেয়নি, এমনকি ছেলে মেয়েকেও দেখতে আসেনা।

IMG_20181125_121830
স্বামীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পর অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। বাজারের একটি ধান ভাঙার মিল থেকে বাকিতে এক বস্তা চাল কিনে প্রথমে তিনি চাল বিক্রি করা শুরু করেন। বস্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল বিক্রি করতে লাগলেন। কোনোদিন আবার চলে যেতেন নেত্রকোনা শহরে। চাল বিক্রি করে যে টাকা লাভ হতো সেটুকু রেখে বাকি টাকা মিল মালিককে দিয়ে দিতেন। এভাবে কিছুদিন কাটলো।

দিন দিন সংসারের চাহিদা বাড়ছে। চাল বিক্রির টাকায় সংসার চলেনা। ছেলে মেয়ে স্কুলে পড়ে। অন্যের বাড়ি কাজ করলে বা ঘুরে ঘুরে চাল বিক্রি করলে তাদের খারাপ লাগে। তাই তিনি উপার্জনের জন্য অন্য উপায় খুঁজতে লাগলেন। তিনি জানতে পারলেন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের একটি অংশে কিছু ঘর তুলে নারীদের দোকান করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। যা বর্তমানে ‘মহিলা মার্কেট’ নামে পরিচিত। সেই দোকান ঘরগুলোতে বেশ কয়েকজন নারী বিভিন্ন উপকরণ সাজিয়ে বিক্রি করতে লাগলেন। পরিষদে যোগাযোগ করে তিনিও ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া নিলেন। এই দোকানে তিনি চা তৈরি করে বিক্রি করতে লাগলেন।

প্রথম একবছর প্রতিমাসে আটশত টাকা করে দোকানের ভাড়া দিতে হতো। কিন্তু রুপার অসহায়ত্বের কারণে লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাঁর দোকান ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন। প্রায় তিন বছর যাবৎ তিনি বিনা ভাড়ায় দোকান চালিয়ে আসছেন।

চাল বিক্রি করা লাভ থেকে এক হাজার টাকা দিয়ে তিনি দোকান শুরু করেছিলেন। তাঁর দোকানের সামগ্রী বলতে দুটি বেঞ্চ, দুটি টেবিল, দুটি কেটলি, একটি চুলা ও কয়েকটি কাপ। দোকান শুরু করার সময় বাজার কমিটি থেকেও কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন। এভাবেই তিনি চার বছর যাবৎ দোকান করে আসছেন। দোকানে চা বিক্রি করে যা লাভ থাকে তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার ও ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছিলেন।

কয়েকদিন আগে তাঁর ছোট ছেলেটি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি দোকানের লাভের টাকাও শেষ হয়ে যায়। ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তাছাড়া চা তৈরির জন্য চিনি, লাকড়ি এগুলোও কিনতে হয়। ৫ সের কয়েল লাকড়ি কিনতে আশি টাকা খরচ হয়। এই লাকড়ি দিয়ে একদিন চা তৈরি করা যায়। বাজারের সকল দোকানিরা তাঁর দোকান থেকেই চা খান। পরিষদের মিটিংগুলোতেও তিনি চা সরবরাহ করেন। সকল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাঁর দোকান খোলা থাকে। শুধু দুপুর বেলা কিছু সময় বন্ধ রেখে বাড়িতে খেতে যান।

IMG_20180926_114912
এখন শীত পড়ছে। তাছাড়া বাজারের ক্রেতাগণ এখন আর শুধু লাল চা খেতে চাইছেনা। তারা বিভিন্ন মসলা দিয়ে তৈরি চা খেতে চাইছে। এই বাজারে একমাত্র নারী দোকানদার হিসেবে যেহেতু রুপা আক্তারের খ্যাতি রয়েছে তাই তিনি চাইছেন তাঁর চা এর ক্রেতাদের আব্দার পূরণ করতে।

কিন্তু দোকান শুরু করার সময় যে সমস্ত উপকরণ যেমন ট্রে, কাপ ইত্যাদি কিনেছিলেন এগুলো এখন নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে কিনতে হলে টাকার প্রয়োজন। টাকার অভাবে এ সমস্ত উপকরণ তিনি কিনতে পারছেন না বলে দোকান প্রায় সময়ই বন্ধ রাখতে হয়। আবার মসলা চা তৈরি করতে গেলে যে সমস্ত মসলার প্রয়োজন হয় তা কিনতেও টাকার দরকার।

বারসিক সব সময় প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণকারী, আগ্রহী ও জীবন সংগ্রামী নারীদের এগিয়ে চলতে সহযোগিতা করে। তাই রুপা আক্তারের চা’ এর দোকানটিকে পুনরায় চালু করতে এবং প্রাকৃতিক উপাদানে চা তৈরি করতে কিছু উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উপকরণ সমূহ হচ্ছে একটি কাঠের শোকেস, ট্রে-২টি, কাপ-১২টি, মসলা রাখার বৈয়াম-১০টি, চা তৈরি করার জন্য কয়েক রকম মসলা এবং একটি ব্যানার ।
গত ২৫ নভেস্বর লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. নুরুল আলম রুপা আক্তারের হাতে উপরোক্ত উপকরণসমূহ তুলে দেন। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বারসিক রামেশ্বরপুর রিসোর্স সেন্টার এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মো. অহিদুর রহমান।

উপস্থিত অতিথিবৃন্দ বারসিক’র এ উদ্যোগের প্রশংসা করেন। ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বলেন, ‘রুপা আক্তার একজন সংগ্রামী নারী। তিনি অনেক কষ্ট করে এবং সততার সাথে জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁর মতো এই বাজারে আর কেউ চা তৈরি করতে পারেনা। আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব আমরা চেষ্টা করি তাকে সহযোগিতা করতে।’ স্থানীয় যুব সংগঠন ‘বন্ধু মহল’ এর সদস্যরা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এরপর রুপা আক্তার উপস্থিত সকলকে চা তৈরি করে পরিবেশন করেন।

happy wheels 2

Comments