কিশোরীদের উদ্যোগে ধানের জাত গবেষণার মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং 

নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের কিশোরী সংগঠনের উদ্যোগে আমন ২০১৮ মৌসুমে এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচন গবেষণা কার্যক্রমের কৃষক মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি। মাঠ দিবসে গ্রামের বিভিন্ন বয়স (শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুব ও প্রবীণ), শ্রেণী ও পেশার ৩০ জন নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করে।

IMG_20181127_111256-W600
দিবসটি উপলক্ষে ধানের জাত গবেষণা প্লটে সকল অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে সরেজমিনে ৫টি প্লটের ধান (স্বর্ণা, নেপালী, সোনালী পাইজাম, চিনিসাগর ও আরপারিনা) পরিদর্শন করে এলাকা উপযোগি (কোন ধরণের সার ও কীটনাশক ছাড়াই ফলন ভাল, রোগ-বালাই আক্রমণ হয়নি, হেলে পড়েনি, উফশী ধানের জাতের চেয়েও অপেক্ষাকৃত ফলন বেশি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে) দু’টি ধানের জাত নির্বাচন করেছে। নির্বাচিত ধানের জাতগুলো হল-সোনালি পাইজাম ও চিনিসাগর।

IMG_20181127_111242-W600
গবেষণার অন্যতম উদ্যোক্তা লাবণী আক্তার গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, ‘বারসিক’র রুখসানা রুমীর কাছে ধানের জাত গবেষণা সম্পর্কে শুনে আমার গবেষণাটি করার আগ্রহ হয়। বাবার সাথে কথা বলে এক কাঠা জমি চেয়ে নিয়ে তাতে আমার কিশোরী সংগঠনের সদস্যদের সাথে আলোচনা করে গবেষণার বিষয়টি ফাইনাল করি। কিন্তু বীজতলা করার সময় না থাকায় বারসিক রামেশ্বরপুর অফিস থেকে ৫টি জাতের ধানের চারা সংগ্রহ করি। বারসিক নিজস্ব জমিতে চারা রোপণ করে অতিরিক্ত চারাগুলো অন্যান্য কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করায় চারা প্রায় শেষ হয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোন রকমে ৫টি জাতের চারা সংগ্রহ করতে পারি। সেই চারা নিয়ে এসে আমাদের সংগঠনের সদস্য, ভাই ও বাপ-চাচাদের নিয়ে জমিতে চারা রোপন করেছি। গবেষণাটি প্রথম করায় অনেক সমস্যা ছিল যেমন- জাত-জাতের মধ্যে দুই ফুট ফাকা রাখা, ৮/৮ ফুট সাইজের প্লট করা হয়নি। পুরো এক কাঠা (১০ শতাংশ) জমিতে ৫টি সারিতে পাঁচ জাতের ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। কোন ধরণের সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করেও পাঁচটি জাতের ধানের ফলনই ভালো হয়েছে। আগামী মৌসুমে আমরা গবেষণা কার্যক্রমটি সঠিকভাবে ও সঠিক নিয়মে করবো।’

IMG_20181127_111402-W600
সংগঠনের অন্যতম সদস্য মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শেফালী আক্তার বলেন, ‘মাঠ দিবসে গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছি। গবেষণা কার্যক্রমটি প্রথম হওয়ায় অনেক গ্যাপ ছিল, তারপরও ভালো ফলন হওয়ায় আমরা আনন্দিত। আগামী মৌসুমে ভাল জাতের ১০-১২টি জাত নিয়ে সঠিক নিয়মে আমরা গবেষণা করবো।’
যুব শিক্ষার্থী মো. রাজেল আহম্মদ বলেন, ‘ধানের জাত গবেষণা সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। আমরা প্রথমে ভেবেছি ৫টি ধানের জাত পাশাপাশি রোপণ করলেই হয়তো গবেষণা হয়ে যাবে। কিন্তু আজ আলোচনার মাধ্যমে গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পেরেছি, যা আগামীতে গবেষণা কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে সহায়ক হবে।’

IMG_20181127_111408-W600
কৃষক মো. আব্দুল আজিজ ও কৃষক মো. জজ মিয়া গবেষণা সম্পর্কে বলেন, ‘মেয়েগুলো জীবনে প্রথম নিজেরা ক্ষেতে ধান চাষ করেছে। তাই তারা সঠিতভাবে লাইন করে চারা রোপণ করতে পারেনি। তবে এবছর তারা যেমন গবেষণা সম্পর্কে জেনেছে, পাশাপাশি আমরা প্রবীণ কৃষকরাও এ গবেষণা থেকে ভালো ২টি ধানের জাত পেয়েছি। ব্রি-৩২, ব্রি-৪৯, ব্রি-৩৪ এইসব ধান ছাড়া আমন মৌসুমে আমাদের কাছে অন্য কোন ধানের জাত ছিল না। কোন ধরণের সার ও কীটনাশক ছাড়া ভালো ফলন দিতে সক্ষম এমন দু’টি ধানের জাত পাওয়ায় আমরা আগামীতে এসব ধানের জাত চাষ করতে পারবো। ব্রি জাতীয় ধানের পাশপাশি আগামীতে এই নতুন দু’টি ধানের জাত আমাদের চাষে যুক্ত হবে। আগামীতে আমরা প্রবীণ কৃষকরাও কিশোরীদের গবেষণার সাথে যুক্ত হবো।’

IMG_20181127_111434-W600
আদিবাসী এলঅকায় আদিবাসী নারীদেরকে মাঠে কৃষি কাজে সরাসরি সম্পক্ত হওয়ার চিত্র চোখে পড়লেও বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে তা খুব কমই দেখা যায়। আদিবাসী এলাকায় নারীরা ধানের চারা রোপণ, আগাছা নিড়ানো, ধান কাটা, ধানের আটি বহন, ধান মাড়াই, ধান শুকানো ও ধান চালাসহ সকল কাজ নারীরা করে থাকে। কিন্তু বাঙালি নারীরা সাধারণত ঘরে ধান শুকানো, ধান চালা, গোলায় তোলার কাজ করলেও মাঠের কোন কাজে তারা সরাসরি অংশগ্রহণ করে না। ফচিকা গ্রামের কিশোরী সংগঠনের সদস্যরা গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, কিশোরী/নারীরাও (বাঙালি) ধান রোপণ, আগাছা বাছাই ও ধান কাটার কাজও তার করতে পারে। বাঙালি কিশোরীদের এই উদ্যোগ সত্যি প্রশংসার দাবিদার। পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের নারীরাও মাঠে ফসল ফলানো এবং গবেষণা কাজে এগিয়ে আসলে কৃষি আরও উন্নত হবে বলে আমরা মনে করি। গ্রামের সকল নারীরাও এ ধরণের কাজে এগিয়ে আসুক এই আমাদের প্রত্যাশা।

happy wheels 2

Comments