শতবর্ষী মোসলেম প্রাং হাত পাতেন না কারো কাছে

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

বাম হাতে বাঁশের লাঠি, ডান হাতে শব্দ যন্ত্র ছোট ঢোল, গালে পাকা দাঁড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের ভাঙা চশমা, কাঁধে সামনে-পেছনে পলিথিনে ঝুলিয়ে রাখা হলুদ রঙের পাপড়, মাথায় গামছা পেচিয়ে রাখা পাবনার ভাঙ্গুড়ার নুরনগর উত্তর পাড়ার বৃদ্ধ মোসলেম প্রাং ২৮ নভেম্বর বুধবার দুপুরে পাপড় বিক্রি করতে করতে হাজির হন চাটমোহরের মির্জাপুর ডিগ্রী কলেজ প্রাঙ্গনে। বয়সের ভারে ঝুলে পড়া চামড়া ওয়ালা হাতে তিনি ঢোল বাজাচ্ছিলেন ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। এমন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিকে পাপড় বিক্রি করতে দেখে স্বভাব সুলভভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করি, চাঁচা বয়স কত আপনার? বয়স দিয়ে কি করব্যান? এমন পাল্টা প্রশ্ন করে মোসলেম প্রাং বলেন, “এক কম একশ বছর। একশ বছর পুড়তি এক বছর নাজাই আছে।’

moslem-1
অনেক দিন আগে নেওয়া তার চশমাটাও বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। চোখে ভালো দেখতে পান না এখন। শরীরে জোড় না থাকলেও কষ্টে শিষ্টে দিনের প্রায় অর্ধেকটাই হাটতে হয় তাকে। মির্জাপুর এবং তার পাশর্^বতী গৌড়িপুর, চিনা ভাতকুর, বাওইহাট এলাকায় পাপড় বিক্রি করেন তিনি। কিছুক্ষণ করে বিশ্রাম নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। ছেলে মেয়েরা কি করে আপনার? এক ছেলে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করে। বৌমা ব্যাংকে চাকরি করে’ বলে দম নেন বৃদ্ধ মোসলেম প্রাং।

অন্য ছেলেরা? ‘না বাপু আর কব লয়। তুমি এত শুন্যা কি করব্যা? সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বৃদ্ধ মোসলেম বলেন, “তুমি খুচায়া খুচায়া সব কথা বার করব্যার চাচ্ছেও। শোন, চা পান খাওয়ার অভ্যাস আছে। অন্য দুই ছেলের একজন দোকানদারী করে একজন হাল আবাদের কাম করে। ছাওয়ালরা তাগারে সাধ্যমত ভাত কাপুর দেয়। সব সময় তো তাগারে কাছে টেকা পয়সা চাওয়া যায় না। অন্যের কাছে হাত পাতা ও ভালো লাগে না। তাই বিশ বাইশ দিন হলো পাপড় বেঁচা শুরু করছি।’

moslem-4
মোসলেম প্রাং বলেন, ‘আমার বাড়ি আছিল চাটমোহরের সমাজ বানিয়াবহু গ্রামে। ব্রিটিশ আমলে ভাঙ্গুড়ার নূরনগরে বিয়ে করি। এর কিছুদিন পর থেকে নুরনগর গ্রামেই বসবাস শুরু করি। স্ত্রী’র পৈত্রিক সম্পত্তিতে ঘর করে আছি। মাঠে এগারো কাঠা ভুঁই ছাড়া আর কিছু নাই। স্ত্রী বয়ষ্ক ভাতা পালিও আমি পাই না। আমার বাড়ির পাশে অন্যরা স্বামী স্ত্রী দুজনই বয়ষ্ক ভাতা পায়। আমি চালি জনপ্রতিনিধিরা কয় ইডা নাকি নিয়মে নাই। এক গাঁয়ে দুই নিয়ম! কি করব? নিজির দুই চার পয়সা লাগে তো। তাই বাধ্য হয়া এই বয়সে পাপড় বেচি।’

চার প্যাকেট পাপড় ৫০ টাকায় কেনেন মোসলেম প্রাং। সেখানে ৮০ পিস পাপড় থাকে। এক টাকা পিস। সব পাপড় বিক্রি হলে মোসলেম প্রাং ৮০ টাকা পান। সকালে পাপড় বিক্রির জন্য বাড়ি থেকে ভ্যানে অষ্টমনিষা পর্যন্ত আসেন। সেখান থেকে হাটা পথ শুরু। দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় অষ্টমনিয়া থেকে ভ্যানে বাড়ি যান। ভ্যানে যাতায়াতে দশ টাকা খরচ হয়। গুমানী নদী পাড়াপাড়ে আরো ৪ টাকা দিতে হয়। সব পাপড় বিক্রি হলে ৩০ টাকা লাভ হয়। এর মধ্যে ১৪ টাকা খরচ হয়ে যায়। ১৬ টাকা অবশিষ্ট থাকে মোসলেম প্রাং এর। এই দিয়ে চা পান খান তিনি।

moslem-5
কাল জয়ী শিল্পী আব্দুল জব্বার ড.মনিরুজ্জামানের কথা ও সত্য সাহার সুরে এতটুকু আশা আ্যালবামে তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয় এ বিখ্যাত গানের শেষ দিকে গেয়েছেন, প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে। কেউ তো জানে না প্রাণের আকুতি বারেবারে সে কি চায়, স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে সরে চলে যায়। ধরণীর বুকে পাশাপাশি তবু কেউ বুঝি কারো নয়। মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই মানুষটি প্রতি দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। স্বার্থের টানে তার প্রিয়জনেরা একে বারে দূরে সরে না গেলেও হয়তো জানে না তার প্রাণের আকুতি। এ ধরণীর বুকে পাশিাপাশি থাকলেও কেউ যেন কারো নয়। কেউ বিলাস বহুল জীবন যাপন করছেন আবার কেউ মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য জীবনের শেষ সময়ে এসেও যুদ্ধ করছেন। কাগজের পাতা ভরে প্রতিদিন অনেক খবর আসলেও মোসলেম প্রাং এবং তার মতো আরো অনেকের জীবন পাতার অনেক খবর আজো রয়ে গেছে অগোচরে।

happy wheels 2

Comments