বিশ্বের সেরা একশত মায়েদের একজন নেত্রকোনার সীমা সরকার

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

সন্তানের জন্য একজন মা কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন তার জীবন্ত প্রমাণ নেত্রকোনার সীমা সরকার। বড় ছেলে হৃদয় সরকার জন্মের পর পরই অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের মত হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে শারীরিকভাবে পঙ্গুত্বকে বরণ করে নেয়। মা সীমা সরকার এই অবস্থাতেও ছেলেকে কোন দিন হুইল চেয়ারে বসাননি। যতদিন তার গায়ে শক্তি থাকবে ততদিন তিনি সন্তানকে সব জায়গায় কোলে করেই নিয়ে যাবেন বলে তিনি ছেলেকে বলেছিলেন।

নেত্রকোনা শহরের কুড়পাড়ে সীমা সরকারের বসবাস। স্বামী সমীরণ সরকার কেন্দুয়া জসিম ভূইয়া ইট খলায় প্রায় ২০ বিশ বছর ধরে কাজ করেন। ২০০০ সালের ২৩ অক্টোবর নেত্রকোনার একটি ক্লিনিকে সীমা সরকার একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। ছেলের নাম রাখেন হৃদয়, কিন্তু জন্মের পর থেকে পুত্রের মুখে কোন শব্দ ছিল না। এই অবস্থায় ছেলেকে সীমা ক্লিনিক থেকে বাসায় নিয়ে আসেন। ছেলের সুচিকিৎসার জন্য তিনি দেশে বিদেশে চিকিৎসকদের শরাণপন্ন হন। তিন বছর বয়সে বসতে শিখে আদরের ছেলে হৃদয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি ছেলেকে নিয়মিত ব্যায়ামের পাশিপাশি নিয়মিত ঔষুধ খাওয়াতেন। বসতে পারলেও ছেলেটি হাটা-চলা করতে পারত না।

Sima Sarker

৬ বছর বয়সে তিনি নেত্রকোনা হলি চাইল্ড স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেন। সীমা সরকার প্রতিদিন কোলে করে ছেলেকে স্কুলে আনা-নেয়া করেন। এভাবেই শুরু হয় প্রতিবন্ধি সন্তানকে নিয়ে সীমার জীবনের যুদ্ধ। ছেলে হলি চাইল্ড স্কুলে পড়াশোনা শেষে ভর্তি হন সরকারী আঞ্জুমান স্কুলে। নেত্রকোনার পের এলাকায় বসবাসরত সকল পিতা-মাতার স্বপ্ন ছেলেকে আঞ্জুমান স্কুলে পড়াবেন। শারীরিক প্রতিবন্ধি হৃদয় সেই আঞ্জুমান স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়। আঞ্জুমান স্কুল থেকে ছেলে হৃদয় সরকার এসএসসি-তে জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হলে তাকে নিকটবর্তী আবু আব্বাস ডিগ্রী কলেজে ভর্তি করেন। কলেজে যাওয়া-আসার প্রধান ভরসা হয়ে পড়ে সীমা সরকারের কোল। আবু আব্বাস কলেজ থেকে ২০১৮ সালে জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে হৃদয়। মায়ের আগ্রহে হৃদয় এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

অধম্য ইচ্ছা শক্তি আর দৃঢ় মনোবল থাকলেই যে, যেকোন অসাধ্যকে সাধন করা যায় তারই প্রমাণ সীমা সরকার। তার স্বপ্ন ছিল জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধি ছেলে হৃদয় সরকারকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি প্রতিবন্ধি সন্তানকে কোলে করে নিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে কলা অনুষদভুক্ত ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে যান। সন্তানকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য কোলে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশ ও বিশ্বে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মায়ের ভালোবাসা মুগ্ধ হয় সারা দেশ ও বিশ্ব। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির প্রকাশিত ১০০ জন প্রেরণাদায়ী নারীর তালিকায় ৮১ নম্বরে স্থান করে নিয়েছে সীমা সরকার।

সীমা বলেন, “আমি আমার অসুস্থ ছেলেকে সব সময় সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছি, নিজে সবসময় কোলে করে নিয়ে গেছি তাকে স্কুল, কলেজসহ সকল অনুষ্ঠানে। আমার ছেলেকে কখনও বুঝতে দেইনি যে, সে শারীরিকভাবে অক্ষম। নিজে পরিশ্রম করেছি আমার স্বামীকেও বুঝতে দেইনি। আমার খুব ভালো লাগছে আমার ছেলেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পেরে, আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েরা যেন অবহেলিত না থাকে, তাই সকল পিতা-মাতার উচিত তাদের প্রতিবন্ধি সন্তানদেরকে লেখাপড়াসহ সকল শিক্ষায় সমান সুযোগ দেয়া, তাদেরকে নিয়মিত উৎসাহিত করা যাতে তারা তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ পায়। তাদের সাথে সবসময় ভালো আচরণ করা, যাতে তারা পরিবার ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। আজ বেগম রোকেয়া দিবসে অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন আমাকে যে সম্মান দিয়েছে তার জন্য আমি সংগঠনের সকল সদস্যদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।”

Sima Sarker in the Rokeya Day
প্রেরণাদায়ী মা সীমা সরকার দেশের প্রতিবন্ধী, অসহায় ও অসুস্থ মানুষের কল্যাণে আজীবন কাজ করে যাওয়ার জন্য এবং প্রতিবন্ধি সন্তানের জন্য সমাজ ও দেশের সকল মানুষের নিকট আর্শীবাদ কামনা করেন। হৃদয় সরকার’র ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক (আইআর) বিষয়ে পড়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সীমা সরকার জানান, দেশের সেবা করার জন্য এই বিষয়টি বড় মাধ্যম বলে মনে করে তার প্রতিবন্ধি ছেলে।

নেত্রকোনা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম জানান, মা ও প্রতিবন্ধি ছেলের এমন সাফল্যের জন্য স্থানীয় প্রশাসন আনন্দিত ও গর্বিত। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধি মেধাবী শিক্ষার্থী হৃদয়ের জন্য সরকারিভাবে সম্ভাব্য যেকোনো ধরণের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, “একটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার মতো বিষয় হয়েছে সন্তানকে অনুপ্রেরণাদায়ী মা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মায়ের স্বীকৃতি পাওয়া। আমি আশা করি প্রতিবন্ধী অসহায় ও অসুস্থ সন্তানেরা এখন আর কারো অবহেলার পাত্র হবে না।”

জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবসে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে হৃদয় সরকারকে একটি স্বয়ংক্রিয় হুইল চেয়ার (ইলেক্ট্রনিক্স) প্রদান করা হয়। ইলেক্ট্রনিক্স হুইল চেয়ার সহযোগিতা পাওয়ায় হৃদয় সরকার এখন নিজে নিজেই চলাফেরা করতে পারছে। তার চলাফেরায় মায়ের পরিশ্রম অনেকটা কমেছে। আসুন আমরা সকলে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রেরণাদায়ী এই মাকে এবং মেধাবী প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হৃদয়ের জন্য দোয়া করি যাতে মা ও সন্তানের স্বপ্ন পূরণ হয়।

happy wheels 2

Comments