রাজশাহীর বস্তির শিশুদের শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম

সম্প্রতি রাজশাহী বড় কুঠি, পদ্মা গার্ডেন কফিবার হল রুমে রাজশাহী শহরের বস্তি শিশুর শিক্ষা ও অধিকার শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও তরুণ সংগঠন বরেন্দ্র শিক্ষা সংস্কৃতি বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্র’র (বিইসিডিপিসি) যৌথ আয়োজনে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ৮টি স্বেচ্ছাসেবী তরুণ সংগঠন, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বস্তি শিশুর পিতা মাতার অংশগ্রহণে সংলাপে বস্তি শিশুদের শিক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের দাবি জানান। সংলাপে মাঠ পর্যবেক্ষণমূলক মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চল সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম।

IMG_2824
মাঠ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অন্যান্য শরের তুলনায় উত্তর পশ্চিম জনপদের সমৃদ্ধ রাজশাহী নগরিতেও দিনে দিনে বস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪’ অনুযায়ী রাজশাহী শহরে বর্তমান ছোট বড় মিলে বস্তি সংখ্যা ১০৪টি, যার লোকসংখ্যা ৩৯০৭৭ জন। এই বস্তিবাসী জনগোষ্ঠীর বৃহৎ একটি অংশ শিশু কিশোর। জাতিসংঘের শিশু সংজ্ঞানুসারে বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ৪৮ ভাগই শিশু। কিন্তু বস্তির এই শিশু কিশোরদের জন্যে উপযোগী কোন সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রম না থাকায় শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে বস্তি শিশুদের শিক্ষা ও অধিকারের দিকটি আরো বেশি নাজুক অবস্থায় প্রতীয়মান হয়। প্রাথমিক শিক্ষায় কিছু সংখ্যক শিশু লেখাপড়া করলেও মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে উঠার আগেই ঝরে পড়ে যায় অনেক বেশি। আবার বস্তি শিশুর সুবিধাজনক প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণেও সে স্কুলে যেতে পারেনা। যদিও শিশু অধিকার সনদে শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আবার দেখা যায়, নানা কারণেই বস্তি শিশুর শিক্ষা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বারসিক ও রাজশাহীর তরুণ সংগঠনগুলোর যৌথ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের বলা হয়:

IMG_2840
০১. স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলগুলোর পরিবেশের সাথে বস্তি শিশুরা শুরুর প্রথম দিকে খাপ খাওয়াতে পারেনা। আবার নানা বঞ্চনার শিকার হন। এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেন অনেকে।
০২. আর্থিক অভাব, ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম, বাবা মার অবহেলা, অসচেতনতার কারনেও শিশুর শিক্ষা সংকট তৈরি হয়।
০৩. অপুষ্টি, রোগ, দারিদ্র, অশিক্ষা, নির্যাতনের শিকার, বাল্য বিবাহ ইত্যাদি কারণেও শিশু শিক্ষা ও অধিকারহীনতা হয়ে যাচ্ছে।
০৪. শিশু স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানির অভাব, গাদাগাদি করে থাকা, পড়ার সুযোগ না পাওয়া।
০৫. বস্তি শিশুদের খেলার মাঠ নেই, খেলার সুযোগ সুবিধা নেই, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক সুবিধা নেই।
০৬. প্রকল্প আসে প্রকল্প যায়। স্থায়িত্ব উন্নয়ন প্রকল্প কম। বস্তি শিশুদের উন্নয়নে বাজেটে আলাদা বরাদ্দের অভাব।
০৭. বস্তি শিশুরা বেশি বৈষম্যের শিকার হয়, যেমন- মেয়ে শিশু, প্রতিবন্ধী, সংখ্যা লঘু ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর শিশরা বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। শিশুরা মতামত প্রকাশ করতে পারেনা।

IMG_2910

সংলাপে সেচ্ছাসেবী তরুণ, বস্তিবাসী শিশু ও অবিভাবকগণ বস্তির শিশুর উপযোগী পরিরেবশ, প্রাক প্রাথমিকসহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সুযোগ সুবিধা, বিনোদন, খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক চর্চা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসহ নিরাপদ আবাসনের দাবি জানান। উল্লেখ্য যে, রাজশাহীতে বস্তি শিশুর শিক্ষা ও অধিকার উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবী ৬টি ( ইচ্ছে, নবজাগরণ, বিআইইস, বিইসিডিপিসি, সূর্যকিরণ, স্বপ্নপুরণ) তরুণ সংগঠন প্রায় ৩০০ শিশুকে নিয়মিত শিক্ষা ও সচেতনতার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

উক্ত সংলাপে অংশগ্রহণ করেন রাজশাহী জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মো. মনজুর কাদের, জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের প্রোগ্রাম অফিসার শিরিন আক্তার, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা কর্মকর্তা আনারুল হক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি ড. আয়নাল হক, রাজশাহী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আসলাম-উদ- দৌলা, সেভ দি ন্যাচার এন্ড লাইফ এর চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, বস্তির নারী প্রতিনিধি রাখিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ববৃন্দ।
সংলাপে জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মো. মনজুর কাদের বস্তি শিশুদের শিশু একাডেমীর সুযোগ সুবিধা, শিশু বিকাশ ও ফ্রি শিক্ষার সুযোগ আছে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘বস্তির সুবিধা বঞ্চিত শিশুর তালিকা করে তাদের পাঠিয়ে দিলে আমরা সেবা দিবো।’ শহর সমাজ সেবা অফিসার আশিবুজ্জামান বলেন, ‘বস্তিসহ দরিদ্র পরিবারে শিশুদের জন্যে ছোট মনি নিবাস, এতিম শিশুদের জন্যে শেখ রাসেল একাডেমি এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যে শিক্ষা বৃত্তিসহ ভাতার বিষয়ে সুবিধা দেওয়া উচিত।

জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের প্রোগ্রাম অফিসার শিরিন আক্তার বলেন, ‘শিক্ষা ও অধিকার নিয়ে তরুণ সংগঠনগুলোকে ফোরাম গঠন করতে হবে। বস্তিতে নারীদের কর্মসংস্থান তৈরীতে তালিকা তৈরী করে দিলে আমরা তাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করবো।’ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার রাজশাহী ব্যুরো প্রধান ড. আইনুল হক বস্তিবাসীর সুবিধা আদায়ে তরুণদের এ্যাডভোকেসী দিকগুলো উন্নত করার পরামর্শ দেন। তিনি সমন্বিতভাবে কাজগুলো করার জন্যে সকল প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা কামনা করেন।

উক্ত সংলাপে বিভিন্ন বস্তি থেকে আগত ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী, তরুণ, সাংবাদিক, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিসহ মোট ৬৫ জন নারী পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।

happy wheels 2

Comments