‘আসুন মগড়া বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই, আমরা বাঁচি’

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং

নেত্রকোনার মগড়া নদী দখলমুক্ত, দূষণমুক্ত ও খননের দাবিতে নেত্রকোনা পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে আজ নেত্রকোনা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির উদ্যোগে এবং সমমনা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অংশগ্রহণে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানববন্ধনে নেত্রকোনা পৌর এলাকার সমমনা বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও বয়সের প্রায় দুই শতাধিক লোক অংশগ্রহণ করেন।

IMG_20190203_111651-W600
ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত মানববন্ধন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্যে মগড়া নদী রক্ষায় জেলা প্রশাসন, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ, বিএডিসি ও জেলা পানি উন্নয়ন র্বোডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বক্তারা বলেন, ‘নেত্রকোনা জেলায় প্রবাহমান বেশক’টি নদীর মধ্যে মগড়া নদী অন্যতম। নেত্রকোনা পৌর এলাকাটি মগড়া নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। এককালের সেই মগড়া কালের আবর্তনের সাথে সাথে এবং শহর দিন দিন সম্প্রসারিত হওয়ায় আজ বিলুপ্তির উপক্রম। শীত মৌসুমে মগড়া নদীতে কোন স্রোত দেখা যায় না। কিছু সংখ্যক ভূমি খেকো ও দখলদারদের কবলে পড়ে মগড়া ক্রমশ দখল ও ভরাট হয়ে সংস্কৃচিত হয়ে পড়েছে।’

IMG_20190203_105341-W600

বক্তারা জানান, পৌরসভার সকল বাড়িঘর ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ময়লা/বর্জ নদীতে ফেলায় তলদেশ যেমন ভরাট হয়ে যাচ্ছে, তেমনি নদীর পাড় ও পানি দূষিত হয়ে বাতাসে দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। যে মগড়া নদীর পানি এক সময় নেত্রকোনা জেলার কৃষকদের ফসলের জমিতে সেচ ও গৃহস্থালী কাজের একমাত্র অবলম্বন ছিল, সে নদীতে আজ পানির বেজায় আকাল চলছে। নদীর কোন কোন অংশে হাত-মূখ ধোয়ার পানি পর্যন্ত নেই। পৌরবাসীরা এই মগড়া নদীর পানিতে গোসল থেকে শুরু করে গৃহস্থালীর অধিকাংশ কাজ করতেন। কিন্তু মগড়া ভরাট, দখল ও পানি দূষিত হওয়ায় নদীতে যে সামান্য পানি এখনও রয়েছে তাও ব্যবহারের অনুপোযোগি। পৌর এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বাড়ি ঘরের ময়লা আবর্জনা, সবজির আড়ত ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহের আবর্জনা এবং কসাইখানার বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট কোন স্থান (ডাষ্টবিন) না থাকায় জনগোষ্ঠী অসচেতনভাবে এবং বাধ্য হয়ে এসব বর্জ্য নদীতে ফেলছে। অথচ জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তপক্ষ এক্ষেত্রে একটু সচেতন হলেই মগড়া নদী অবৈধভাবে দখল, ভরাট ও দূষণ থেকে রক্ষা পেত, নদী ফিরে পেত সেই আগের প্রবাহ। পৌর এলাকার মানুষ এবং গ্রামের মানুষ নদীর পানি কৃষিসহ বিভিন্ন গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের সুযোগ পেত।

IMG_20190203_112304-W600

বক্তারা আরও বলেন, ‘মগড়া আজ শহরের ময়লা আবর্জনা ও পয়ঃনিষ্কাশনের ভাগাড় হয়ে উঠেছে। দেশের অন্যান্য সব মুর্মূষু নদীর মতই দখল, দূষণ আর অপঘাতে মগড়া নদী আজ এক করুণ চেহারা ও পানি শূন্য কংকালসার শরীর নিয়ে দাঁড়িয়েছে। মগড়া নদীকে আমাদের অবশ্যই বাঁচাতে হবে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও গতিপথ নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এটি আমাদের আজ ও আগামীর টিকে থাকবার জন্য এক প্রধান শর্ত। নদীর সংকট আমাদের শংকিত করেনি। বিবেক আমাদের তাড়িত হয়নি। সভ্যতা আমাদের সঠিক মাত্রায় সভ্য করেনি। পরিবেশ ভাবনা আমাদের ভাবিত করেনি। নদীর প্রতি উদাসীনতা আমাদের বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করছে। আমাদের অপরাধ আছে, বোধ নেই। বিবেক আছে, তাড়না নেই। দৃষ্টি আছে, দর্শন নেই। মন আছে মননশীলতা নেই। মগড়া আমাদের অস্তিত্বের অংশ, মগড়া আমাদের নান্দনিকতার উৎস। মগড়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সচল ধারাকে অবলুপ্ত করতে চাই না।’

IMG_20190203_113557-W600

বক্তারা নেত্রকোনা অঞ্চলের বসবাসরত বিশেষভাবে মগড়া পাড়ের এবং পৌরএলাকায় বসবাসকারী সকল শ্রেণী, পেশা, বয়স, ধর্ম ও বর্ণের মানুুষকে আহবান করে বলেন, ‘আসুন, আমরা নিজেকে নিঃশর্তভাবে মগড়ার কাছে নিয়ে যাই। নদীকে নদীর মতো করে, নদী ভেবে নদীর কাছে ফিরিয়ে দিই। আসুন সকলে মিলে মগড়া নদীর প্রাণে স্্েরাতের হাসি ফোটাই। আমরা আজ মগড়া নদী বাঁচানোর দাবী মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নিকট তুলে দিতে চাই। তাই আসুন আমরা সকলে সমবেত কন্ঠে বলে উঠি ‘আসুন মগড়া বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই, আমরা বাঁচি’।

IMG_20190203_113910-W600

মানববন্ধন অনুষ্ঠানে আলোচনা শেষে নেত্রকোনা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির নেতৃত্বে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে পৌরসভার সামনে থেকে একটি র‌্যালি বের হয়ে জেলা প্রশাসক এর কার্যালয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নিকট মগড়া নদীর দখলমুক্ত, দূষণমুক্ত ও খননের দাবি দাওয়া সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদানকালে সেখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আন্দোলনকারীরা মগড়া নদী রক্ষায় জেলা প্রশাসনের যথাযথ উদ্যোগ কামনা করেন। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড মগড়া নদী দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত করে নদীর পানি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার উপযোগি করা এবং নদীর পাড়ে সৌন্দর্য্য বর্ধণের জন্য ইতিমধ্যে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জেলা প্রশাসক জানান। তবে নদী দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি বেশকিছু সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দখলদার প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি হাইকোর্টে স্থাপনা ভাঙ্গার আদেশের বিরুদ্ধে রিট করেছে। তাই সেসব স্থাপনা রেখে অন্য স্থাপনাগুলো ভাঙ্গা সাধারণ মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হবেনা। তবে যেসব স্থাপনা সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হয়েছে সেগুলো উচ্ছেদ করা কোন সমস্যা হবে না’ নদীতে যাতে ময়লা আবর্জনা না ফেলে সে বিষয়ে পৌরবাসীদেরকে সচেতন করতে আন্দোলনকারীদেরকে তিনি সচেতনতামূলক উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানান।
IMG_20190203_113639-W600
মানববন্ধনে বারসিক, জেলা উদীচী, নাগরিক আন্দোলন, প্রাণ ও প্রকৃতি বাঁচাও, স্বাবলম্বী, নারী প্রগতি, নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ, জন উদ্যোগ, সমকাল সুহৃদ, প্রথম আলো বন্ধসভা, নেত্রকোনা প্রেসক্লাব, হিমু অড্ডা, উম্মেষ উচ্চ বিদ্যালয়, আমাদের আড্ডা, দলাই পাড়ের কিশোরী সংগঠন, কাইলাটি শীতল পাটি কিশোরী সংগঠন, ফচিকা অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন, সম্মিলিত যুব সমাজ, নেত্রকোনা ডিবেট এসোসিয়েশন প্রমূখ সংগঠন অংশগ্রহণ করে। আলোচনায় বক্তাদের মধ্যে ছিলেন, অধ্যাপক নাজমুল কবীর সরকার, আলপনা বেগম, অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বাবুল, অধ্যাপক রুস্তম আলী, স্বপন পাল, অধ্যাপক কামরুজ্জামান চৌধুরী, অধ্যাপক নিরঞ্জন পাল, অধ্যাপক তপন সাহা, শ্যামলেন্দু পাল, তানভিরজাহান চৌধুরী, সাংবাদিক শেখ আব্দুল্লাহ, শিক্ষিকা তপু রায়, অহিদুর রহমান প্রমূখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কবি ও ছড়াকার সঞ্জয় সরকার।

happy wheels 2

Comments