কেমন আছেন ভাষা শহীদ রফিকের পরিবার

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥

১৯৫২ সালে যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম মাতৃভাষা। তাদের মধ্যে অন্যতম শহীদ রফিক। তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে যারা বেঁচে আছেন, কেমন আছেন তারা? রফিকের স্মৃতিবিজড়িত জন্মভিটার খবর নিতে সরিজমিন সিঙ্গাইরের পারিল (বর্তমানে রফিক নগর) গিয়ে দেখা গেল প্রকৃত অবস্থা।

শুধু মাত্র ভাষার মাস এলেই পরিবারটির কদর বাড়ে। ঘনকালো চুল, লম্বা নাক, কিছুটা উঁচু দাঁতের অধিকারী, শ্যামল কালো পাতলা গড়নের দুরন্ত ডানপিঠে এক কিশোর ছিলেন শহীদ রফিক। ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর সিংগাইর উপজেলার অজো পাড়া গাঁ পাড়িল গ্রামে তার (বর্তমানে রফিক নগর) জন্মগ্রহণ করেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। রফিকের দাদার নাম মোঃ মকিম। শৈশবে গ্রামের স্কুলেই তিনি লেখাপড়া করেন। মরহুম আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী ও বীরেন্দ্রমোহন দত্তগুপ্ত শিক্ষকদ্বয়ের সুযোগ্য ছাত্র হিসাবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন।

1 (8)

এ গ্রামেই তার শৈশব -কৈশোর কেটেছে। বাবার নাম আবদুল লতিফ ও মা রোমেজা খাতুন। ৫ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রফিক ছিলেন সবার বড়। ভাইদের মধ্যে একমাত্র জীবিত আছেন রফিকের ছোট ভাই খোরশেদ আলম। ভাই হারানোর কষ্ট আর বেদনায় আজো কেঁদে উঠেন তিনি। ছোট ভাই খোরশেদ আলমের বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। বড় ভাই রফিকের কোনো স্মৃতিই তার মনে নেই। তবে মায়ের মুখে রফিকের অনেক গল্পই তিনি শুনেছেন। খোরশেদ আলম বলেন, ‘শুনেছি বড় ভাই রফিক ছোট বেলায় বেশ চঞ্চল ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই লেখা পড়ার পাশাপাশি সাহিত্য ছড়া রচনা, সেলাই সুচি শিল্পে তিনি ছিলেন বেশ পারদর্শী। এলাকার মানুষের দুঃখ-কষ্টে সব সময় তিনি নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যেতেন। সমাজ কল্যাণমূলক কাজে সে থাকতেন সবার আগে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিংগাইর উপজেলার বয়রা স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগে অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি ঢাকা জগন্নাথে লেখাপড়া করেন। মায়ের মুখে আরও শুনেছি, ঢাকায় থাকাকালিন সময় লেখাপড়ার পাশাপাশি রফিক বাবার সঙ্গে প্রেসের ব্যবসায় সহযোগিতা করতেন। এ সময় তার বিয়ের কথা চলছিল গ্রামে। সেদিন আমার বাবা আবদুল লতিফ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি পাড়িল চলে যান বিয়ের দিন তারিখ ধার্য করতে। গ্রামের নাসির উদ্দিনের কন্যা পানু বিবির সঙ্গে বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়। কিন্তু বিয়ের পিড়িতে বসা হয়নি।’

images

১৯৫২ থেকে ২০১৯, পেরিয়ে গেছে কয়েক’টি যুগ। কিন্তু আজো স্মৃতি রক্ষায় ও সংরক্ষণের নেই তেমন কোন উদ্যোগ। বাড়ির ঐতিহ্য রক্ষা করতে শহীদ রফিকের ছোট ভাই মৃত আব্দুল খালেকের স্ত্রী গোলেনূর বেগম (৭১) বসবাস করছেন এখানে। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘এই বাড়ির স্মৃতি রক্ষায় আমাকে এখানে থাকতে হচ্ছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেসব মানুষ এসে শহীদ রফিক সম্পর্কে তথ্য চাচ্ছেন তা দিতে দিতেই আমি ক্লান্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘রফিকের একমাত্র জীবিত ভাই খোরশেদ আলম মানিকগঞ্জ সদরে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত বাড়িতে থাকেন। আমি আজ অসুস্থ। সবাই আসেন সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে। কেউ আমাদের খবর রাখেন না। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের কথা মনে পড়ে। রফিকের ছোট ভাইয়ের ছেলে শাহজালাল ওরফে বাবু তার স্ত্রী ও গোলেনূর বেগম আছেন এই বাড়িতে।

শহীদ রফিকের ভাবি গুলিনূর বেগম তার মৃত স্বামী ও শাশুড়ির কাছে শোনা কথার বরাত দিয়ে জানান, বাল্যকাল থেকেই তিনি (শহীদ রফিক) ছিলেন চঞ্চল প্রাণোচ্ছল। ছিল গাছে চড়ার প্রচন্ড শখ। গাছে চড়তে গিয়ে তো একবার তার পা ভাঙে। চিকিৎসার জন্য সে সময় তাকে কলকাতা পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিল। ভাষা শহীদ রফিকের আরেক ভাই খোরশেদ আলম স্বপরিবারে থাকেন মানিকগঞ্জ শহরের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের সন্নিকটে। অন্য ভাইয়ের সন্তানাদী ঢাকায় বসবাস করেন।

রফিকের বাড়ির সন্নিকটে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি লেঃ কর্নেল অবঃ মুজিবর ইসলাম খান তার নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছেন শহীদ রফিক দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। ২০০৬ ইং সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এখানে বিনামূল্যে এলাকার দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করা হয়। প্রতি মাসে দুদিন এখানে ওষুধপত্র বিতরণ করা হলেও সেগুলো বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কোম্পানি থেকে অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত।

4 (3)

মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ রফিক স্মরণে গত ২০০৭ সালে রফিকের বসতভিটার অদূরে পারিল গ্রামে মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনায় ৫৭,১০,০০০/- টাকায় নির্মিত হয়েছে রফিক উদ্দিন আহমেদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি যাদুঘর। শহীদ রফিকের দু-এক বছরের বড় দেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সৈনিক পারিল গ্রামের প্রবীণ নাইবউদ্দীন জানান, যে আদর্শ আর লক্ষ্যকে সামনে রেখে রফিক সেদিন মাতৃভাষার আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে আমাদের বিগত সরকারগুলো কেন যেন কুণ্ঠাবোধ করেছেন। তিনি জানান, সরকার যদি প্রথম থেকেই ইতিবাচক কর্মসূচি গ্রহণ করতো তাহলে আজ ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর পারিল গ্রামে অনেক কিছুই করা সম্ভবপর ছিল। এই প্রবীণ বললেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সোপান আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন। আর ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ রফিক।

এ গ্রামের প্রবীণ মো. আখের উদ্দিন তার পিতার কাছে শুনেছেন, ১৯৫৩ সাল থেকেই এলাকার মানুষ রফিক স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। ১৯৫৩ সালের এক মাহেন্দ্র দিনের কথা। প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের সময়ে সারাদেশে পাকিস্তানী জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হলেও পারিল গ্রামে সেদিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ – সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়েছিল। আর সেদিন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী বাংলাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নীনা হামিদ পরিবেশন করেছিল জাতীয় সঙ্গীত।

5

3 (1)শহীদ রফিকের ছোট ভাইয়ের ছেলে শাহজালাল ওরফে বাবু বলেন, ‘আমার চাচা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ কারণে দেশবাসীসহ বিশ্ব তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তাই আমি তার পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করি।’ এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘সরকার শহীদ রফিকের নামে তার নিজ গ্রামে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। এই মহান শহীদের নামে মানিকগঞ্জের প্রধান সড়কের নামকরণ করা হয় শহীদ রফিক সড়ক এবং মানিকগঞ্জ-হেমায়েতপুর ভায়া সিংগাইর সড়কে বংশী নদীর উপর নির্মিত ব্রিজটির নামকরণ করা হয়। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তার বসতবাড়িতে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনসহ গুরুত্বপূর্ণ আরো বই যেন পর্যাপ্ত থাকে, সে বিষয়ে অবশ্যই জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

 অমর একুশে পরিষদ, রফিক নগরের সভাপতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার তোবারক হোসেন লুডু বলেন, ‘৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি মুলত অংশগ্রহণ করেছিলাম ভাষার জন্য শহীদ রফিকের আত্ম ত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তার জন্য পারিল তথা পুরো জেলার মানুষ গর্ববোধ করে।’

কালের খড়গ পেড়িয়ে এখনো তাঁর পরিবারের কাছে টিকে আছে শহীদ রফিকের গায়ের পাঞ্জাবী, পড়নের লুঙ্গি। স্মৃতির সুগন্ধি জড়ানো এই লুঙ্গি-পাঞ্জাবী এক সময় হারিয়ে যাবে সময়ের গোধুলী লগ্নে। কিন্তু রফিক নামের অণির্বান দ্বীপশিখা জ্বলবে বাঙালির বর্ণমালায়, বাউলের সুরে সুরে, হিজল-তমাল-কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম আভায়। বিশ্ব স্মরণ করবে তাদের; জাতি শ্রদ্ধাভরে গর্ব করবে চিরকাল।

happy wheels 2

Comments