হাওয়া আক্তার: গ্রামীণ নারীদের এগিয়ে যাওয়ার এক সাহসের নাম

নেত্রকোনা থেকে মো. আলমগীর

হাওয়া আক্তারের নিরন্তর এগিয়ে চলা
আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের রামজীবনপুর গ্রামের নারী হাওয়া আক্তারের পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৫জন। একই ইউনয়নের গিডুয়ারী গ্রামের সন্তোষেন্নেসা ও ছৈয়দ আলীর বড় সন্তান হাওয়া আক্তার ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে পার্শবর্তী রামজীবনপুর গ্রামের কবির হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। হাওয়া আক্তারের সাহসী পদক্ষেপ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে সহযোগিতা ও সাহস যোগিয়েছে। ১৯৮৫ সালে প্রথম তিনি ভূমিতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় গ্রামীণ নারীদের নিয়ে গিডুয়ারী গ্রামে নারীদের নিয়ে ভূমিহীন একতা সংগঠন গড়ে তোলেন, যার সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয় তাকে। গ্রামের কিছু ভূমিহীন নারী সরকারের কিছু খাস জমি বন্দোবস্ত পায়, গ্রামের মানুষ হাওয়া আক্তারের ক্ষমতা দেখে কিছুটা অবাক হয়, নারীরা পায় সাহস। এই সাফল্য হাওয়া আক্তরকে গ্রামের পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য কিছু করার প্রেরণা জোগায়। বিয়ের পরে রামজীবনপুর গ্রামের পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্যও কিছু করার চেষ্টা করেন। হাওয়া আক্তার অনুধাবন করেন নারীদের হাতে টাকা না থাকার কারণে নিজের অনেক ইচ্ছায় প্রকাশ করতে পারেনা। এটি অনুধাবন করে গ্রামের নারীদের অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে এলাকার চাহিদার কথা বিবেচনা করে বাঁশ বেতের কাজে নারীদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেন। নারীদের এই প্রচেষ্টাকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন বারসিক। এই দক্ষ নারীদের দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রদানসহ এলাকায় কোন কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে, পণ্য তৈরির উপকরণসহ বিপননের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। আস্তে আস্তে গ্রামের অনেক নারীই যুক্ত হয় এই কুটিরশিল্প কাজে। ২০০৫ সালে ২৫টি পরিবারের নারীদের সম্পৃক্ততায় হাবাদা কটির শিল্প নারী সংগঠন। সংগঠিত নারীরা কুটিরশিল্পভিত্তিক অর্থ উপার্জন, পরিবারের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নে নানারূপ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

হাওয়া আক্তারের গতিশীল নেতৃত্ব
হাওয়া আক্তার হাবাদা গ্রামের নারীদেরকে চারটি ব্লকে ভাগ করে সংগঠনের চারজন দক্ষ উদ্যোগী নারীকে দায়িত্ব দিয়েছেন তাদেরকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য। নিজে আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রাম পুলিশ হিসেবে যুক্ত হয়ে গ্রামের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও গ্রাম পুলিশ হিসেবে নারীদের যুক্ততাকে গ্রামের মানুষ এখনও ভালোভাবে গ্রহণ করেনি তথাপি হাওয়া আক্তার এই চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করছেন। 12নিজ সংগঠনের নেতৃত্ব ছাড়াও তিনি স্বরমুশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের পারিবারিক বিরোধ নিরসন, নারী ও শিশু কল্যাণ বিষয়ক স্টাডিং কমিটির সদস্য, বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির সংগঠক, নেত্রকোনা জেলা জনসংগঠন সমসন্বয় কমিটির সদস্য, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রামীণ ধাত্রী, স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী, বারসিক নেত্রকোনা রিসোর্স সেন্টারের সর্বোচ্চ পরিষদ রিসোর্স সেন্টার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সক্ষমতা ও দক্ষতার পরিচয় বহন করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে গ্রামীন সমাজের তৃণমূল নারীদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। হাওয়া আক্তার বলেন, ‘গ্রামের ছেলে ও মেয়েরা মানুষ হিসেবে সমান সুযোগ,অধিকার, মর্যাদা ও আত্মবিশ^াস নিয়ে বড় হবে। তবেই নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে একটি সমমর্যাদা ও সমঅধিকারভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।’

প্রান্তিকতাকে আপন করার প্রক্রিয়া
গ্রামের পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ নিরোসন, অসহায় নারীর পাশে দাড়ানো, অধিকার আদায়ে মানুষকে সম্পৃক্ত করা, নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদানসহ ধারাবাহিক কর্মপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে হাওয়া আক্তার হয়ে উঠেছেন একজন দক্ষ ও সাহসী সমাজকর্মী। তিনি এ পর্যন্ত প্রায় ৭৩জন গর্ভবতী নারীর নিরাপদ সন্তান প্রসব করিয়েছেন, বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে গ্রামের দরিদ্র ছেলে মেয়েদের শিক্ষা উপকরণসহ শিক্ষা বৃত্তি পেতে সহযোগিতা করেছেন, গ্রামীণ নারীদের সরকারি ও বেসরকারি দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ, ৭০টি দরিদ্র পরিবারে বিনামূল্যে টয়লেট তৈরির উপকরণ, গ্রামের ২৫ জন নারীকে ধাত্রী প্রশিক্ষণ গ্রহণে সহায়তা,স্বাস্থ্য ও ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্প আয়োজনে সহযোগিতা, এলাকার প্রায় ১০০ জন নারীকে সরকারের বিভিন্ন কমিটি ও কর্মসূচিতে যুক্ত করার মাধ্যমে নারীদের মতামত প্রদান ও কর্মসংস্থান তৈরিতে সহযোগিতা, এলাকার ৫০ দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ড এবং ০২ জনকে বিধবা ভাতা কার্ড, ৮ জনকে ন্যায্য মূল্যের চাল, ৩ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে সহায়তা করেছেন। স্বপ্নচারী এই নারী তার চিন্তাচেতনা, নানামূখী কর্মদক্ষতা ও উদ্যোগের ভেতর দিয়ে এলাকার প্রান্তিক ও অসহায় নারী পুরুষের কাছে অনন্য এক ভরসা ও সাহসের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

13

বর্তমানে হাওয়া আক্তার স্বরমুশিয়া গ্রামের একজন গ্রাম পুলিশ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করলেও তিনি গ্রামের নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এলাকা এদের কোন সমস্যা হলেই তাদের পাশে রয়েছে হাওয়া আক্তার। এসব কারণে হাওয়া আক্তার শুধু তার নিজ পরিবার বা গ্রামের মানুষের কাছেই নয় আশেপাশের গ্রামের অসহায় দুঃখী মানুষের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনন্য এক শক্তি ও সাহসের নাম।

happy wheels 2

Comments