খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য

বারসিকনিউজ ডেক্স

জাতিসংঘের সাধারণ সভার দ্বিতীয় কমিটিতে প্রথম উত্থাপিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের’ কথা এবং ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এটি পালিত হতো প্রতিবছরের ২৯ ডিসেম্বর। কিন্তু জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০০০ সালের পর থেকে ডিসেম্বর মাসের পরিবর্তে প্রতিবছর ২২ মে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে উৎযাপিত হয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালকে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য বর্ষ ঘোষণা করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ প্রতিবছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে, ২০১৯ সালের জন্য প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে “(Our Diversity, Our Food, Our Health)” যার বাংলা করা যেতে পারে পারে “খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য”। প্রকৃতিতে দেখা-অদেখা জানা-অজানা দৃশ্য কি অদৃশ্যমান সকল প্রাণের বহুপাক্ষিক বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যই প্রাণবৈচিত্র্য। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদে (১৯৯২) ‘প্রাণবৈচিত্র্য’ বলতে বোঝানো হয়েছে : স্থল, সমুদ্র, জলভাগ প্রতিবেশসহ সকল এলাকার জীবন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্যকে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর প্রথম অধ্যায়ের সংজ্ঞায়ন অংশে প্রাণবৈচিত্র্যকে ‘জীববৈচিত্র্য’ প্রত্যয় হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেখানে জীববৈচিত্র্য বলতে-জল, স্থল ও সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমে বসবাসকারী সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বা উপ-প্রজাতিসমূহের মধ্যে জেনেটিক ও প্রজাতিগত ভিন্নতাকে বোঝানো হয়েছে। দুনিয়ায় প্রাণের বৈচিত্র্য এতই ব্যাপক যে এখন পর্যন্ত এর সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয় পৃথিবীতে সর্বনিম্ন ১ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৮ কোটি বিভিন্ন ধরনের প্রাণের উপস্থিতি রয়েছে।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য সম্পর্কে বর্ণনায় আইইউসিএন বাংলাদেশকে প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে উল্লেখ করে। তাদের এক সমীক্ষা মতে, বাংলাদেশে ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৬৩০ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ২২ প্রজাতির উভচর, ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণ, ৩২৭ প্রজাতির শামুক ঝিনুক, ৬৬ প্রজাতির কোরাল, অসংখ্য পোকামাকড়, ৫০০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ যার ভেতর ১৬০ প্রজাতির শস্য রয়েছে । ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশী ধানের জাত নামে একটা বইয়ে ১২৪৮৭টি স্থানীয় জাতের ধানের নাম উল্লেখ রয়েছে এছাড়া অপর এক সমীক্ষা থেকে ৩৬৪৫ জাতের পাট জাতের বৈচিত্যের কথা বলা হয়েছে। বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন বারসিকের সহযোগিতায় কৃষকদের উদ্যোগে ৭৭৭ জাতের ধান সংগ্রহ করে এলাকা উপযোগি ফসলের জাত নির্বাচন বিষয়ক প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অর্থাৎ আয়তনে ছোট হলেও কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশকেই আমরা দেখতে পাই। ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ, ১৭টি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চল, ২৩০টি নদ-নদী, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন, দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, হাজারো ধানের জাত, বৈচিত্র্যময় খাদ্য ও প্রাকৃতিক উৎস, ৪৫ জাতিসত্ত্বা নিয়ে পৃথিবীর বুকে বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এক অনণ্য নাম বাংলাদেশ। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন অবকাঠামো, পরিবেশ বিনাসী কর্মকান্ড, কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও বিষের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, দখল ও দুষণ, কৃষি জমির হ্রাস ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সেই সাথে বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেশের প্রাণ ও প্রকৃতির উপর তেনিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেশের মানুষসহ সকল প্রাণসত্ত্ব্রা নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন পরিকল্পনা। কেননা এমনিতেই দেশের প্রাণ ও প্রকৃতি পরিবেশগত ও নানাবিধ উন্নয়ন দূর্যোগের সংকটে আবর্তিত। এর ভেতর বৈশ্বিক উষ্ণতা খাদ্য উৎপাদন ও জোগানের চালিকাকে আরো জটিল করে তুলছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে এক অপূর্ব লীলাভূমি বাংলাদেশ। এদেশে প্রকৃতি তার দুহাত উজাড় করে দিয়েছে তার প্রাকৃতিক শোভা। নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাওর-দিঘী-জলাশয়-পাহাড়-বন-জলভূমি-সমতলভূমি-বরেন্দ্রভূমি-উপকূল সব মিলিয়ে সেই সমৃদ্ধিরই এক প্রতিচ্ছবি। সেই সমৃদ্ধ প্রকাশিত হয় শত শত পুকুরের গল্প, জনপদ ঘেরা নদীর গল্প, বৃক্ষের গল্প, হাওরের গল্প, পাহাড়ের গল্প, নানা প্রজাতির পাখি, প্রাণীর গল্প, বৈচিত্র্যময় মাছের গল্প, মাটির গল্প মিলে এই জনপদের এক সমৃদ্ধ জীবনের গল্পের ভেতর দিয়ে। তবে প্রকৃতির সাথে মানুষের গভীর সম্পর্কের এই সমৃদ্ধ গল্পের যেন ছন্দপতন হচ্ছে, বাড়ছে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেকার ব্যবধান। ধীরে ধীরে মানুষ সরে যাচ্ছে প্রকৃতির কাছ থেকে আর প্রকৃতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষের কাছ থেকে। যা একদিকে যেমন পরিবেশের জন্যে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে তেমনি মানুষের মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনুষত্বের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক অতি প্রাচীন ও বহুপাক্ষিক। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের স্পর্শে প্রকৃতি, প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষ নিজেদের করেছে সমৃদ্ধ, হয়েছে বিকশিত। টিকে থাকার সংগ্রাম উভয়কেই করেছে বৈচিত্র্যময়। প্রকৃতি মানুষের হৃদয়ে বপন করেছে ¯েœহের বীজ, মানবিকতার বীজ, জ্ঞানের বীজ, সম্ভাবনা ও সংগ্রামের বীজ। প্রকৃতির উপাদান ব্যবহার করে মানুষ খাদ্য ফলাতে শিখেছে, লজ্জা ঢাকবার জন্যে বস্ত্র বানাতে পেরেছে, গাছের লতাপাতা ব্যবহার রোগমুক্তির উপায় লাভ করেছে, প্রাণীকে কাছে ডাকবার জন্যে সুর সৃষ্টি করতে শিখেছে, মনের ভাব প্রকাশের জন্যে আঁকতে শিখেছে, শিকারের প্রয়োজনে বাজাতে শিখেছে, নাচতে শিখেছে। প্রকৃতিই মানুষকে শিখিয়েছে কিভাবে দলবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় পৃথিবীতে। সে অর্থে প্রকৃতি হলো মানবজাতির জীবন্ত পাঠাশালা। আবার প্রকৃতির সাথে নারীর রয়েছে এক সুগভীর সম্পর্কে যা পরস্পরের পরিপূরক। নিত্য কৌতুহলী নারী খাদ্য সংগ্রহের জন্যে ঘুরে বেড়িয়েছে বন থেকে বনে। সংগ্রহ করেছে বীজ, সেই বীজ এনে মাটির গর্ভে বপন করেছে, জন্ম দিয়েছে বৃক্ষের, ফুটিয়েছে ফুল, ফল ও শস্য। চাষকে কেন্দ্র করে বন্ধ করেছে খাদ্যঅন্বেষণে ঘুরে বেড়ানো, শুরু করেছে সুবিধাজনক স্থানে বীজ বপন, বসবাস ও রাত্রি যাপন করা। জীবনের প্রয়োজনে শিখেছে গাছের পাতা, বাকল দিয়ে সুরক্ষা। সন্তান জন্মদান, লালন পালনের মধ্য দিয়ে পরিবার কাঠামো উদ্ভব বিস্তারের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাই অগ্রগণ্য। বস্তুত প্রকৃতির সকল সৃষ্টি ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় নারীই ভূমিকাই মূখ্য।

বাংলাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসই বলে, এখানে প্রকৃতি ও মানুষ অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু সে সম্পর্কে আজ চির ধরেছে। প্রকৃতির কান্না আমাদের কানে পৌঁছায় না। প্রতিদিন আমরা তার প্রাণনাশের আয়োজন করে চলেছি। ফলে প্রতিদিন প্রাণীর সাথে মানুষের দূরত্ব বাড়ছে, দূরত্ব বাড়ছে জলের সাথে, মাটির সাথে, বায়ুর সাথে। এ দূরত্ব শিশুর বেড়ে উঠাকে করে তুলছে বৈচিত্র্যহীন। যে শিশু ঘুম থেকে ওঠে আকাশ দেখতে পারে না, খালি পায়ে ঘাসে হাঁটতে পারে না, পাখির ডাক শুনতে পারে না, ঝিরিঝিরি বাতাসে খিলখিল করে হাসতে পারে না, মাছের সাথে সাঁতার কাটতে পারে না, গাছের ফুল ফল ফুটতে দেখেনা, প্রাণীর সাথে খেলা করে না, নদীর ¯্রােত দেখে না, সে কিভাবে সৃজনশীল, সাহসী ও আবেগপ্রবণ হবে? কীভাবে এই প্রজন্ম বৈচিত্র্যকে ধারণ করবে? কারণ ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সাথে মানুষের আচার আচরণ, কৃষ্টি সংস্কৃতি, রাজনীতির এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতি অদৃশ্যভাবে চিরকাল সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। এই যে মানুষে মানুষে এত হানাহানি, বনিবনা হয় না ভাইয়ে ভাইয়ে, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো, যুব সমাজ নেশাসহ নানা রকম অপরাধ কর্মে লিপ্ত, সংস্কৃতিতে পড়েছে ভাটা, ভাটা পড়েছে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে-এগুলোর জন্যে দায়ী এক বৈচিত্র্যবিমুখ সময়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোনভাবেই মানুষের মূল্যবোধগুলোকে জাগ্রত করতে পারছে না। শিক্ষিত হয়েও মানুষ অবিবেচকের মত আচরণ করছে। সমাজে খুন হত্যা ধর্ষণ, গুম, চুরি ডাকাতিসহ নানারকম সামাজিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে। এমনই সঙ্কটময় অবস্থানে আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে বৈচিত্র্যহীন প্রকৃতির মানুষ কখনই বৈচিত্র্যময় হতে পারে না, চারপাশের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারেনা। আর মানুষের অবক্ষয় শুরু হয় চারপাশের প্রতি তার অসংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ থেকে। তাই তো আমরা দেখছি প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য যত কমছে সেখানে ধেয়ে আসছে অবক্ষয়। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পন্থা হচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ প্রকৃতি। যা দিয়ে শুধু সকল প্রাণসত্তার খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবেনা সেই সাথে আমাদের চিন্তা চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে চারপাশের জন্য প্রকাশিত হবে সংবেদনশীলতা।

happy wheels 2

Comments