নদীতে পোনা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দূর্যোগে নারীরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ সময় প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য দেশের বিভিন্ন স্থানে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজ করতে চলে যাচ্ছেন। ফলে অভিভাবকশূন্য পরিবারটির সব দায়িত্ব পড়ে যাচ্ছে নারীর উপর। অনেক সময় কাজের সন্ধানে বাইরে থাকা স্বামীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারে না নারী। ফলে দিন দিন তাদের পারিবারিক বন্ধন ক্ষীণ হতে থাকে। তাছাড়া অনেকে সময়মতো সাংসারিক খরচ পাঠাতে পারে না। এতে বাড়িতে থাকা নারীকে সংসার সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। আবার অনেক বিধবা নারীর পরিবারে উপার্জন করার মতো কোন লোক না থাকাই সমস্ত দায়িত্ব ঐ নারীকেই নিতে হচ্ছে। নারীর দায়িত্ব তখন সংসার সামলানোতেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবন ধারনের জন্য অর্থ উপার্জন করার দায়িত্ব ওই নারীকেই নিতে হচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় তাকে। ফলে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আর নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার কারণে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।

27
উপকূল অঞ্চলে নদী ভাঙ্গন ও নানা ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে এবং লবণ পানির চিংড়ি ঘেরের দাপটের কারণে অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়ছেন। এদের বেশির ভাগই কৃষি বা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল মানুষ। পুরুষ শ্রমিকরা কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে গেলেও বেশির ভাগ সময় নারী শ্রমিকরা বাড়িতে বেকার পড়ে থাকেন। অর্থ উপার্জনের বিকল্প কোন পথ না থাকায় নারীরা তখন বাধ্য হচ্ছেন নদীতে মাছের রেনু পোনা সংগ্রহ করতে।

উপকূল অঞ্চলের শ্যামনগর উপজেলার ঝাঁপা গ্রামের একাদশী মন্ডল (৪৬) বলেন, ‘অনেক সময় ভোর রাতে নদীতে জাল টানতে গেলে খুব ভয় লাগে। নদীতে কামট, কুমোর, সাপ, সোস থাকে আবার হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে যখন তখন ঝড় উঠতে পারে যে কোন মুহুর্তে বিপদ আসতে পারে। তাছাড়া নদীর পানির ভিতর সবুজ রঙ্গের কিরাল সাপ (সাপটি লম্বা হয় ৩/৪ ফুট এবং চওড়া হয় ২/৩ ইঞ্চি) থাকে কামড় দিলে মানুষ বাঁচে না। শুধু সংসার চালাতে ভয়ডর বাদ দিয়ে নদীতে পোনা ধরতে নামতে হচ্ছে।’ পাখিমারা গ্রামের বিধবা নারী নুরনাহার (৪৮) বলেন, ‘হ্যাচারীর মালিকরা সাগর থেকে মা মাছ ধরে নিচ্ছে এবং তাছাড়া নদী মরে যাচ্ছে। তাই সাগর থেকে মাছ উপরের দিকে আসতে পারছে না। যে কারণে নদীতে মাছ ও পোনা কম পড়ছে। তাছাড়া নদীতে জেলের সংখ্যা ও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যদি ১০ জন জাল টানতো কিন্তু বর্তমানে ১০০ জন জাল টানছে।’

SAM_0754

অন্যদিকে কামালকাটি গ্রামের সীতা রাণী মন্ডল (৪৯) বলেন, ‘প্রতিদিন ৪/৫ ঘণ্টা লবণ পানিতে থাকার কারণে গা হাত পা চুলকায়, পানির ভিতর নোনা পোকা থাকে সেটা গায়ে লাগলে ঘা হয়ে যায় এবং প্রচুর জ্বালা করে। উরুতে এক ধরনের জাওয়ালী (ফুসকড়ি) বের হয় হাটতে গেলে খুব জ্বালা করে। সমস্ত গায়ে ঘা-পাঁচড়া, এজমা, গা-পা ফোলা, পায়ে কুনুক (নখের কুনি বসা), হাটুতে ব্যাথা, হাত পা খেয়ে যায়, সর্দি জ্বর, মাথা যন্ত্রণা করে। বছরে একটা মোটা টাকা চিকিৎসার পিছনে ব্যয় করতে হয়।’

SAM_0760

বন্যাতলা গ্রামের সাবানা খাতুন (২৯) মোমেনা বেগম (৪৭), গড়কুমারপুর গ্রামের মিজানুর রহমান (৪৮),পশ্চিম বিড়ালাক্ষী গ্রামের জহুরা বেগম (৪৫),পদ্মপুকুর গ্রামের রেশমা বেগম (৩০) জানান, বিকল্প আয়ের পথ না থাকায় বাধ্য হয়ে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে চিংড়ীর পোনা আহরণ করছেন। প্রতিদিন ভাটার সময় ছোট জাল দিয়ে শুধু বাগদার পোনা আহরণ করেন। পরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে যে অর্থ পান তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। গোনমুখে ভাটার সময় ২০০ থেকে ৩০০ টাকার চিংড়ি পোনা আহরণ করেন। উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ চিংড়ি পোনা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, নদী থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ বন্ধ রাখতে হলে তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

happy wheels 2

Comments