নেত্রকোণায় দেশীয় জাতের মোরগ-মুরগি’র প্রায়োগিক গবেষণা

নেত্রকোণা থেকে মো. আলমগীর

আদিকাল থেকেই মানুষ সম্পদ ও সাথী হিসেবে পালন করে আসছে মোরগ-মুরগি, হাঁস-কবুতর, গরু-ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, কুকুর-বিড়ালসহ নানান প্রাণিসম্পদ। এক সময় এগুলো ছিল মানুষের সম্পদ, নিরাপত্তা, বাহন এবং বিপদের বন্ধু। আমাদের দেশের গ্রামীণ পরিবার যুগ যুগ ধরে নিজের সম্পদ হিসাবে মনে করেছেন তার বসত ঘরের মাচার নিচের খুকরিটি (হাঁস-মোরগ-মুরগি রাখার ছোট্ট ঘর)। এই খুকরিতেই পালন করা হত স্থানীয় জাতের হাঁস মোরগ-মুরগিসহ অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণিসম্পদ। নিজের প্রয়োজনের সময় হাঁস-মুরগি বিক্রি করে সংসারের আর্থিক চাহিদা মেটান গ্রামের মানুষরা। শুধু তাই নয়, খুব সহজেই নিজেদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও আসে এই সব গৃহপালিত প্রাণিসম্পদ থেকে। এই প্রাণিগুলো পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে টিকে থাকার সক্ষমতাও অনেক বেশি। এরা পরিবারের উচ্ছিষ্ট খাবার এবং বাড়ির চারপাশ থেকে ছোট ছোট পোকামাকড়, ঘাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খাবার খেয়েই বেঁচে থাকে।

IMG_20190623_121519

আমাদের দেশে বর্তমানে বাণিজ্যিক খামারে দ্রুত বর্ধন ও অধিক উৎপাদনক্ষম ব্রয়লার, লেয়ার ও শংকর জাতের প্রাণিসম্পদ পালন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ এদের মাংস ও ডিম খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় দেশীয় জাতের হাঁস-মুরগি পালন আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যার ফলে দেশীয় জাতগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই প্রেক্ষাপটে নেত্রকোণা জেলার সদর উপজেলা, আটপাড়া, কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা উপজেলায় দেশীয় জাতের প্রাণিসম্পদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য বারসিক রামেশ্বর রিসোর্স সেন্টার’র উদ্যোগে ৫টি গ্রামে একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয়। সমীক্ষা ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, নেত্রকোনা অঞ্চলে এখনও ছয় জাতের দেশীয় মুরগি রয়েছে। সেগুলো হল ১. ফুটফুটি জাত ২. গলা ছিলা জাত ৩. টিক্কাওয়ালা ৪. লম্বা পায়া জাত ৫. নাইরা এবং ৬. আসিল মুরগি। এই মুরগিগুলো পরিবেশ/প্রকৃতির সাথে লড়াই করে যুগ যুগ ধরে টিকে রয়েছে গ্রামের নারীদের কাছে।

IMG_20190721_161802

স্থানীয় জাতের মুরগি সংরক্ষণ, বর্ধন এবং তুলনামূলক বেশি উৎপাদনশীল (ডিম ও মাংস) জাত নির্বাচনের লক্ষ্যে উল্লেখিত ছয়টি জাতের মধ্যে থেকে গলাছিলা জাতের মুরগি নিয়ে বিগত জুন ২০১৯ থেকে আটপাড়া উপজেলার অভয়পাশা গ্রামে প্রায়োগিক গবেষণা শুরু করা হয়। গবেষণার জন্য ১২০ দিন বয়সের গলাছিলা জাতের ছয়টি মুরগি এবং একটি মোরগ ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষণার জন্য অভয়পাশা গ্রামে একটি গ্রামীণ বাড়ি নির্বাচন করা হয় যেটি অন্য বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত। এই বাড়িতে আর অন্যকোন জাতের মোরগ-মুরগি নেই। উক্ত বাড়িটির চারপার্শ্বে খুব কাছে কোন বাড়ি না থাকায় গবেষণাকৃত গলাছিলা জাতের মুরগিগুলো অন্য বাড়ির মোরগের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ কম। উন্মুক্ত পালন পদ্ধতিতে স্থানীয় জাতের মুরগিগুলো যেহেতু পরিবারের উচ্ছিষ্ট খাবার এবং বাড়ির চারপাশ থেকে নিজেরাই খাবার সংগ্রহ করে খায় ও প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে, তাই আবদ্ধ ঘরে বন্ধ করে পালন না করে উন্মুক্ত পালন পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়। এই প্রায়োগিক গবেষণায় মুরগিকে কোন পোল্ট্রি ফিড সরবরাহ করা হবে না। তবে বিরূপ আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক খাবার সংগ্রহে বিঘ্ন হলে দিনে ২/৩ বার প্রতিটির জন্য ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম ধান, চাল, ধানের কুড়া, খুদ বা ভাত দেওয়া হবে। বাসস্থান হিসাবে বসত ঘরের একপার্শ্বে ৫ঢ১০ বর্গফুট আকারের একটি বাঁশের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ডিম দেওয়া এবং বাচ্চা ফুটানোর জন্য ঘরে মধ্যেই আলাদা জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। মুরগিগুলো প্রায় ১৫০ দিন বয়সে ডিম দেওয়া শুরু করলে প্রচলিত নিয়মে ডিম সংরক্ষণ এবং বাছাইকৃত উর্বর ডিমগুলো হাজলে বসিয়ে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটানো হবে। সদ্যজাত বাচ্চাগুলো প্রচলিত নিয়মে পালন করা হবে। পালনকৃত বাচ্চাগুলোর বয়স ৯০-১২০ দিন হলে এই জাতের মুরগি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী ব্যক্তি নির্বাচন করে বাচ্চা ক্রয় করে পুনরায় তার সাথে প্রায়োািগক গবেষণার কাজ শুরু করা হবে। অন্যদিকে কোন আগ্রহী বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করতে চাইলে বাজার মূল্য অনুযায়ী ডিম সংগ্রহ করে জাত বর্ধনের কাজ করা হবে। গলাছিলা জাতের মুরগির রোগ-বালাই সাধারণত খুবই কম দেখা যায়। কেননা এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। এর পরেও রোগ প্রতিরোধের জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের সাথে পরামর্শক্রমে ভ্যাকসিন বা ঔষধ প্রয়োগ করা হবে।

IMG_20190721_161932

গ্রাম এলাকায় পরিবার পর্যায়ে পরিচালিত এই প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রমটি এলাকার মানুষের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি দেশীয় জাতের প্রাণিসম্পদ সংরক্ষণ ও বিস্তারের মাধ্যমে গলাচিলা জাতটির অধিকতর সম্প্রসারণ হবে এমন প্রত্যাশা করাই যায়।

happy wheels 2

Comments