নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন যে নারীরা

নেত্রকোনা কলমাকান্দা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

ভূমিকা  
“অধিকার মর্যাদায় নারী পুরুষ সমানে সমান” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে কলমাকান্দা উপজেলায় ৮ মার্চ পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৬। এই দিনে অনেক বক্তাই সমাজে নারীর অবস্থা ও অবস্থানের উন্নয়নের জন্য সমাজকে আরো উদার হওয়ার আহবান জানান। দীর্ঘদিন ধরে নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিমূহূর্তে লড়াই করছে একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। বছরব্যাপী বিচ্ছিন্নভাবে এই লড়াই গতিশীল থাকলেও ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনে সারা বিশ্বের নারীরা সম্মিলিত হয়। এই দিনেই জেগে ওঠে নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতার মূলে কঠিন আঘাত করার জন্য এবং অধিকার ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য গণজাগরণ তৈরি করবে বলে। গণজাগরণ শুরু হয়ে গেছে সমাজের সকল স্তরের নারীদের মাঝে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের নারীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারাও আজ স্বপ্ন দেখছেন, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন। এমনই কয়েকজন সাহসী নারী যাঁরা সংসার জীবনের বহুমাত্রিক আঙ্গিকে জড়িয়েও সমাজ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে কাজ করে যাচ্ছেন সুদূর স্বপ্ন বাস্তবায়নের অগ্রযাত্রী হিসেবে। এই লেখায় নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৃণমূল পর্যায়ে (কলমাকান্দা) সংগ্রাম-আন্দোলন করে যারা নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে তাদের কথা তুলে ধরা হলো:

সফল জননী পারভীন আক্তার
পারভিনা আক্তার (৪৫) একজন কুটির শিল্পী। কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের ভেলুয়াতলী গ্রামে বাস করেন। ৫ মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জননী তিনি। টানা তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাকে নিয়ে পাড়া প্রতিবেশি উপহাস করেছিল! পরিবার ও সমাজে তাকে হেয় করা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি ক্ষান্ত হননি। তিনি বিচলিত না হয়ে কীভাবে সন্তানদের ‘মানুষ’ করবেন সেই চিন্তাতেই মগ্ন ছিলেন। তিনি বলেন, “মাইয়া অইছে দেইখা আমারে মানুষ যেসব কথা শুনাইছে, আমি মাইয়াদের শিক্ষিত করাইয়া তাদের দেখাইয়া দিমু যে মাইয়ারাও ছেলের সমান, এমন জেদ ধরছে আমার মনে”। Nari-1
পারভীন আক্তার তার কথা রেখেছেন। তিনি সব সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলেছেন। বর্তমানে তার বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দিতীয় মেয়ে ডিগ্রি, তৃতীয় মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ছেলে এই্চএসসি, চতুর্থ মেয়ে দশম এবং পঞ্চম মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশুনা করছে। পারভীন আক্তার বাঁশ বেতের কাজ করেই মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বাঁশ দিয়ে দাড়ি, পাটি, কুলা, ডালা, চালুন, পায়লা তৈরি করে তা থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন। স্বামীর আয় এবং নিজের আয়ের টাকা পুরোটাই সন্তানদের পড়াশুনার জন্য ব্যয় হওয়াতে বাড়ি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি। কিন্তু তার জন্য তিনি আফসোস করেন না। শুধু মনের কোনে ইচ্ছে ও স্বপ্ন লুকিয়ে রেখেছেন একটি পাকা বাড়ি তৈরি করার। ১৬ শতাংশের মতো বসতভিটেতে ছোট দু’টি ঘর আছে। তার মধ্যে একটি গোয়াল ঘর। বাড়ির চারপাশে এবং ঘরের চালে সারাবছর সবজি চাষ করেন। ফলে সবজি বাজার থেকে তেমন ক্রয় করতে হয় না। বর্গাচাষ করার ফলে বছরের ছয় মাস পর্যন্ত চাল ক্রয় করতে হয় না। তারপরও লেখাপড়ার খরচ চালাতে তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। এসবের মধ্যেও তার দৃঢ় ইচ্ছা প্রত্যেক সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন।
যেখানে অনেক মা হাইস্কুলে পড়ার সময়ই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার কথা চিন্তা করেন সেখানে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে থেকেও পারভীন আক্তার মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখার সাহস করছেন। জীবনের অনেক চাহিদা অপূরণীয় রেখে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কঠিন সময় পার করে চলেছেন। তার এই পথচলা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার হতে পারে; স্বপ্ন দেখার সাহস যোগাতে পারে।

সমাজ সেবিকা আয়েশা খানম
আয়েশা খানম (৪৬) একজন গৃহিনী। নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার বিশারা গ্রামের অধিবাসী। তার ৭ সন্তান (মেয়ে ৪)। স্বামী রিক্সাচালক। নিজের বসতভিটে পর্যন্ত নেই। বোনের বসতভিটেতে একটি ছোট্ট ঘর নির্মাণ করে সেখানেই অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছেন। নিজের পরিবারের হাজারও সমস্যার মাঝেই তিনি নিজের কাঁেধ তুলে নিয়েছেন সমাজ সেবার মতো গুরু দায়িত্ব। এই দায়িত্ব কেউ তাকে দেয়নি নিজের বিবেকের তাড়না ও মানসিক প্রশান্তি থেকেই স্বেচ্ছায় এই গুরু দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেছেন বলে তিনি জানান। Nari-2
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সব মানুষের সহযোগিতা বিশেষ করে তার চারপাশের মানুষের। যারা তার স্বপ্নকে গতিশীল রাখতে সাহায্য করবে। তাই তিনি ‘আশার আলো’ সংগঠন তৈরি করে অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও তা টিকিয়ে রেখেছেন। সংগঠনের সদস্যরা তার সংগ্রামের সহযোদ্ধা হয়ে তাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন নিরন্তর। প্রাথমিক শিক্ষা সমস্যা সমাধানের জন্য সদস্যদের সহযোগিতায় তিনি এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাশ্বর্ঁবর্তী গ্রামে ব্র্যাক সংস্থায় যোগাযোগের মাধ্যমে ব্র্যাক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার ফলে ছোট ছোট শিশুরা বাড়ির পাশেই শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ পেল। বর্ষাকালে নদী পাড়াপাড়ের মাধ্যমে স্কুলে যাওয়ার কোন ধরনের ঝুঁকি আর থাকলো না। ফলে দুটি গ্রাম (বিশারা, কুয়ারপুর) এলাকার বছরের ছয় মাসে যেসব শিশু স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকতো এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হল।
এছাড়াও তার এলাকায় রয়েছে যোগাযোগের সমস্যা। বর্ষাকালে চলাচলের জন্য রাস্তা নেই। তাই রাস্তার জন্য তিনি এইজিইডি অফিসের হিলিপ প্রকল্পে স্থানীয় প্রশাসনের চেয়ারম্যানের সুপারিশ ও এমপি মহোদয়ের ডিউ লেটার সংবলিত একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। রাস্তা এখনো হয়নি তবে তার জন্য তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। ইউনিয়ন পরিষদে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে শীতকালে (৬ জানুয়ারি ২০১৬) ১০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের তিনি পাশ্ববর্তী উপজেলা দূর্গাপুরের চন্ডিগড় ইউনিয়নে অবস্থিত মানব কল্যাণ আশ্রম থেকে সাদাছড়ি ও কম্বল পেতে সহযোগিতা করেছেন।
এছাড়াও তিনি নিয়মিতভাবে ঝুকিপূর্ণ গর্ভবতী মায়েদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অনেক মা ও শিশুদের জীবন বাঁচাতে সহযোগিতা করেন। দুঃস্থ ও অসহায় রোগীরা তার সহযোগিতা কামনা করলেই তিনি নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
তিনি সর্বদা স্বপ্ন দেখেন তার গ্রাম একটি উন্নত ও সুন্দর গ্রাম হিসেবে গড়ে উঠবে। যেন বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম সুষ্ঠুভাবে উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। তার পারিবারিক জীবনেও রয়েছে বহুমাত্রিক সমস্যা। তারপরও তিনি থেমে নেই। তিনি বলেন “যে কাজে আমি হাত দিসি সেই কাজ আমি শেষ কইরা ছাড়বো, যে যাই কউক, আমি মনে শান্তি পাই। তাই সমাজের ও মানুষের উপকার করি।” তার মতো অনেক নারীই হয়তো সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন মনের এক ভালোলাগার অনুভূতি থেকে। এমন নারীদের অনুপ্রেরণা জাগাতে পারে আয়েশা খানমের পথচলা।

পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চাকারী রোকেয়া বেগম
রোকেয়া বেগম (৩৮) একজন কৃষাণী। কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের ভেলুয়াতলী গ্রামের অধিবাসী। স্বামী একজন কৃষক।  ৪ সন্তানের  (ছেলে ২ মেয়ে ২) জননী তিনি। সারাবছর তিনি বসতভিটে, পুকুর পাড় ও জমিতে সবজি চাষ করেন। শাক-সবজিতে তিনি কোন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না। তিনি পোকা দমনের জন্য জৈব বালাইনাশক তৈরি করেন এবং তা ব্যবহার করেন। ফলে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য তিনি পরিবার ও প্রতিবেশীদের উপহার দিচ্ছেন। পাশাপাশি বালাইনাশক তৈরির উপকরণ (বিষকাটালি, নিম, মেহগনি প্রভৃতি) গাছ সংরক্ষণ করছেন। মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য তিনি কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করে সেই কম্পোস্ট সবজি ছাড়াও ধানের জমি ও অন্যান্য ফসল চাষেও ব্যবহার করছেন। তিনি স্বামীকে ধানের জমিতে কেঁচো কম্পোস্ট দেয়ার কাজে সহযোগিতা করেন। ওই এলাকায় তিনিই প্রথম বিষ ছাড়া সবজি চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর সফলতায় অন্যদের উৎসাহিত করেছে। তাঁর এই উদ্যোগ কৃষিক্ষেত্রে যেমন উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে দিয়েছে তেমনি তিনি পরিবেশ ও কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে। Nari-3
জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে তার উৎপাদিত শাকসবজি বাজারে ভালো মূল্য পাচ্ছে। খুব দ্রুতই সবজিগুলো বিক্রি হয়। কেঁচো কম্পোস্ট নিজের চাহিদা মিটানোর পর উদ্বৃতগুলো তিনি বাজারে বিক্রি করেন। বছরে তিনি প্রায় ১৫-২০ মণ কেঁচো কম্পোস্ট বিক্রি করেন বলে জানান। প্রতিকেজি কম্পোস্টের মূল্য ১৫ টাকা দরে বিক্রি করেন। এই কম্পোস্ট মাছের খাবার হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় হওয়ায় মাছ চাষীরাও তাঁর কাে ক্রয় করেন। ফলে সারাবছর কেঁচো কম্পোস্টের চাহিদা থাকে। এটি তাকে ঘরে বসে বাড়তি টাকা আয় করার সুযোগও সৃষ্টি করে দিয়েছে।
জৈব কৃষির চর্চার সফলতা রোকেয়া বেগমকে অনন্য পরিচিতি দিয়েছে। উৎপাদন খরচ কমিয়ে কীভাবে কৃষিতে লাভবান হওয়া যায় সেটা তিনি সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন। তার গ্রামের অন্য নারীরও এতে উৎসাহিত হয়েছেন। নিজে আয় করেন এবং পরিবারে বিভিন্ন কাজে তিনি অবদান রাখছেন বলে পরিবারে ও সমাজেও তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা অন্য নারীকেও স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করেছে।

উপসংহার
প্রতিবছর রোকেয়া দিবসে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে নারীদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জয়িতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। জয়িতাদের জীবনের গল্প সহভাগিতা করেন যা অনেক নারীকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ও স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। এই লেখায় বর্ণিত তিনজন নারীও ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে জয়িতা। তাদের অবদান ও প্রচেষ্টা সবসময় পরিবার, সমাজ ও পরিবেবেশকে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সুদূর স্বপ্নের অগ্রযাত্রী হয়ে পথ চলতে চলতে নারী নিজে সমৃদ্ধ হবে এবং অন্যকে সমৃদ্ধ করার ক্ষমতা অর্জন করবে। তাই প্রত্যেক নারীকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

happy wheels 2