সাম্প্রতিক পোস্ট

বাল্য বিয়েকে ‘না’ বলে স্বপ্ন পূরণের দিকে ছুটছেন মোর্শেদা

রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম শহিদ ও অমৃত সরকার

‘আমি বিয়ের আগেই আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই; বিয়ের পরে নয়’। কথাটি বলেছেন রাজশাহী তানোর উপজেলার শিবনদীর পাড়ে গোকুল মথুরা গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের মেয়ে মোর্শেদা। মোসলেম উদ্দিন পেশায় একজন মৎস্যজীবী। বাড়ি ছাড়া সহায় সম্বল কিছুই নেই তার! প্রতিদিন নদীতে মাছ ধরে ৪ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের ভরণপোষণ দায় দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে। নদীতে তো সব সময়ই মাছ থাকে না; বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাসে নদীতে পানি কম থাকায় মাছ পাওয়া যায় না। এ দু’মাসে মোসলেম উদ্দিনের সংসার খুবই টানাপোড়েনের ভেতরে যায়। মোসলেম উদ্দিনের দু’মেয়ে রয়েছে। ছোট মেয়ে গোকুল মথুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং বড় মেয়ে গোকুল মথুরা দাখিল মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। দু’মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে একসময় হাঁপিয়ে উঠেন তিনি। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন ৮ম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত বড় মেয়ে মোর্শেদাকে বিয়ে দেওয়ার!

কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি নয় মোর্শেদা। মোর্শেদা ছোটবেলা থেকেই শিক্ষকতা করার স্বপ্ন দেখে আসছে। লেখপড়া করে তিনি শিক্ষক হতে চান। কিন্তু বিয়েতে বসলে তিনি এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না বলে মনে করেন! তাঁর ধারণা শিক্ষক হওয়ার জন্য তাঁর মেধাসহ সবকিছু আছে। পিতার অসামর্থতার কারণে তার এই স্বপ্নকে তিনি বলি দিতে চান না!। তাই তিনি উপায় খুঁজেন কিভাবে তিনি লেখাপড়া করতে পারেন; লেখাপড়ার খরচ নিজেই যোগাতে পারেন! মোর্শেদার এই ইচ্ছার কথা জানার পর এগিয়ে আসে সেই গ্রামেরই সেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্নচারীর’ সভাপতি রুবেল। “স্বপ্নচারী সংগঠন”-এর সদস্যরা প্রথমেই  মোর্শেদার বাবাকে মেয়েকে বাল্যবিবাহ না দেওয়ার অনুরোধ জানান। তারা তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, বাল্যবিবাহ একটি অপরাধ এবং সামাজিক ব্যাধি। এভাবে থমকে যাওয়া মোর্শেদার লেখাপড়া আবার শুরু হলো!

Murshedaঅভাব অনটনের সংসারে নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগানোর জন্য হাল ধরলেন মোর্শেদা নিজে! মোর্শেদা গ্রামের কাপড়ের নকশা সেলাইয়ের কাজে নিযুক্ত করেন ‘স্বপ্নচারী’ সংগঠনের সদস্যদের সহযোগিতায়। গ্রামের অন্যান্য মেয়েরা তাঁকে এ কাজে সহায়তা করেন। এ কাজ করে প্রতিমাসে অন্তত তিনি তার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ যোগাতে পারেন। এমনকি মাঝে মাঝে বাবাকেও সে সাহায্য করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে মোর্শেদা বলেন, “আমাদের গ্রামে কাপড়ে নকশা সেলাইয়ের কাজ করে অনেক মেয়ে। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারি রাজশাহী থেকে ব্যবসায়ীরা কাপড়ের নকশা করার কাজ দিয়ে থাকে। গ্রামে যেসব মেয়ে সেলাই জানে তারা এ কাজ করে ঘরে বসে আয় করতে পারেন। আমিও তাদের দলে যুক্ত হলাম।” তিনি আরও বলেন, “ আমি কাপড় সংগ্রহ করে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেলাইয়ের কাজ করি। এখান থেকে প্রতিমাসে আমি ৩০০-৪০০ টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে আমি আমার লেখাপড়া খরচ, পোষাক ও খাতা কলমের কেনার কাজে ব্যবহার করি। মাস শেষে কিছু টাকা জমা থাকে। অনেকসময় বাবার হাতে টাকা না থাকলে আমি আমার জমানো টাকা থেকে তাঁকে সহায়তা করি।”

মোর্শেদা  শুধু লেখাপড়া নয় খেলাধুলাসহ চিত্রাংকনেও যথেষ্ট পারদর্শী। খেলাধুলা ও চিত্রাংকনে তিনি নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন পুরুষ্কার অর্জন করেন। এ প্রসঙ্গে ‘স্বপ্নচারী’ সংগঠনের সভাপতি রুবেল হোসেন বলেন, “মোর্শেদা নিজের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে যে প্রত্যয় ও সাধনা দেখিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। মোর্শেদার এই আত্মপ্রত্যয় ও উদ্যম গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েকে অনুপ্রাণীত করবে।”

বিয়ের আগেই স্বপ্ন পূরণ করার প্রত্যয় নিয়ে জীবন গড়ার সংগ্রাম শুরু করেছেন মোর্শেদা। নিজের ইচ্ছাশক্তি, স্বপ্নকে পূরণ করার প্রত্যয় এবং শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার মানসিক শক্তির কারণে তিনি বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলতে পেরেছেন। মোর্শেদার এই প্রত্যয় ও সাহস অন্য মেয়েদেরকেও অনুপ্রাণীত করুক, তারাও বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলতে শিখুক-এ কামনা করি।

happy wheels 2