একজন সফল কৃষক ও সংগঠকের গল্প

মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে শিমুল বিশ্বাস

মাঝারী ধরনের কৃষক ইমান আলী। জমাজমি বেশি নেই। তবে যেটুকু জমি আছে তাতে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করেন তিনি। ভালো কৃষক ও সৎ মানুষ হিসাবে এলাকায় যথেষ্ট পরিচিতি আছে তার। মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার নয়াবাড়ি গ্রামে তাঁর বসবাস। কৃষি কাজে উপার্জিত অর্থ দিয়েই তিনটি সন্তানকে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন কৃষক ইমান আলী। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে মাস্টারস ডিগ্রি শেষ করে বর্তমানে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে গ্রন্থাগারিকের পদে চাকুরি করছেন। বাকী দুই ছেলে আকবর আলী ও সুলতান আলী ঢাকা কলেজে ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে মাস্টার ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত। ছেলেদের সাফল্য তার মর্যাদাকে আরো প্রসারিত হতে সহায়তা করেছে। যে কারণে তিনি বর্তমানে বায়রা ইউনিয়ন কষি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য, সরকারের কৃষি বিভাগের উদ্যোগে গঠিত সিআইজি কমিটির সভাপতির পদে যুক্ত হতে পেরেছেন।
কৃষক ইমান আলী বড় ভালোবাসেন কৃষি পেশাকে। ভালোবাসেন রাসায়নিক ও কীটনাশক বর্জিত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে। কারণ তিনি মনে করেন যে কৃষি পেশার জন্য আজ তিনি সমাজে অনেকটা মর্যাদার আসন পেয়েছেন। আর মর্যাদা পেয়েছেন বলেই পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে আসেন গ্রামের মানুষ। নিজের কাজ ফেলে তাদের সমস্যা সমাধানে আপ্রাণ চেষ্টা করতে কোনরকম দ্বিধা করেন না তিনি। মেয়ের বিয়ে থেকে শুরু করে জমি জমা সংক্রান্ত নানা ধরনের কাজে সাথে যুক্ত হয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি। তার জন্য এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধও তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। যে কারণে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আগে ডাক পড়ে কৃষক ইমান আলীর। এতে তার সাংসারিক কাজের অনেক ক্ষতি হয়। স্ত্রী রাবেয়া বেগম তাতে কখনো রাগ করেন না। বরং তাকে উৎসাহিত করেন।

IMG_20190912_123656
শুধু কি তাই? বারসিক’র সহায়তায় গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণীর কৃষক কৃষাণি নিয়ে গঠন করেছেন ‘নয়াবাড়ি কৃষক কৃষাণি সংগঠন’। যে সংগঠনের ব্যানারে এলাকার একাধিক প্রান্তিক কৃষকের নানামূখী সমস্যা সমাধানে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রেখে চলেছেন। সম্প্রতি কৃষক ইমান আলীর সাথে একান্ত আলাপনে জানতে পারা যায় যে, তিনি ইতিমধ্যে নয়াবাড়ি গ্রামের ঘোড়ামারা খালের ব্রীজ প্রাপ্তি, নয়াবাড়ি আদর্শগ্রামের রাস্তায় ইটের সলিং করানো এবং উক্ত গ্রামের ১০১টি পরিবারের নুতন বিদ্যুৎ সংযোগ এবং সংগঠন ও সংগঠনের বাইরের কৃষকদের কৃষি, হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের আয়বৃদ্ধিমূলক দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাছাড়া এলাকার কৃষি জমির জলাবদ্ধতা দূরীকরণে চেয়ারম্যানের নিকট কালভার্ট স্থাপনের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান, সাংবাদিকের নিকট জলাবদ্ধতার সমস্যা উপস্থাপন এবং সর্বোপরি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কৃষক সম্মেলনের মাধ্যমে কৃষকের এসব সমস্যা সমাধানের নিয়মিয়ত দাবি উত্থাপন করে চলেছেন।

IMG_20171025_124934

ভালো মানুষ ও সংগঠক হিসাবে গ্রামের সাধারণ জনসাধারণের কাছে যেমন সমাদৃত, তেমনি ভালো মানের কৃষক হিসাবে উপজেলা কৃষি বিভাগের কাছে যথেষ্ট গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছেন ইমান আলী। তাই তো তাঁর গ্রামে সরকারের সেবা সহযোগিতা বণ্টনে তার উপর দায়িত্ব দেন সিংগাইর উপজেলা কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে। কৃষক ইমান আলীর জবানীতে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ৩৫ জনকে বিভিন্ন ভাতা পেতে সহায়তা করেছেন। এর মধ্যে ৭ জন প্রতিবন্ধী, ৬ জন বিধবা, ৫ জন গর্ভবতী, ৬ জন শিশু এবং বাকি ১১ জন বয়স্ক মানুষ রয়েছেন।

20180610_132445
তাছাড়া কৃষি বিভাগ থেকে চলতি বছর ৩ জন কৃষক ২৬,৫০০ টাকা মুল্যের কৃষি উপকরণ সহায়তা পেয়েছেন কৃষক ইমান আলীর সহায়তায়। এ সব উপকরণের মধ্যে রয়েছে মিনি সেচ পাম্প, ফিতা পাইপ, ড্রাম, হ্যান্ড সাওয়ার ইত্যাদি। তাছাড়া কৃষক ইমান আলী, আ: রাজ্জাক, আ: সামাদ কৃষি বিভাগ থেকে ধানের এবং আ: মোতালেব ভুট্টার প্রদর্শনী প্লট পেয়েছেন। অন্যদিকে ১৭ জন কৃষক বীজ ও সার পেয়েছেন কৃষক ইমান আলীর নেতৃত্বে।

এলাকার প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন আন্দোলন। কৃষক ইমান আলীর উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে অন্য ইমান আলী, ইব্রাহিম মিয়া, লাইলী বেগম, আ. মোল্লা, আ. করিম, খোদেজা বেগম, বাবুল হোসেন, শহীদ মিয়া, ইন্তাজ আলীসহ বেশ কিছু কৃষক জৈব পদ্ধতি অনুসরণ করে শাকসবজি চাষ করে চলেছেন। শুধু উৎপাদন নয়; এসব কৃষকের উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারসহ রাজধানী শহরে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে চলতি বছর লক্ষাধিক টাকা আয় করতে সহায়তা করেছেন।

IMG_20190114_111919
তিনি মনে করেন, বর্তমান সরকার কৃষক তথা কৃষি উন্নয়নের পক্ষে যথেষ্ট ইতিবাচক ও আন্তরিক। তবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নকারী/ সেবাদানকারী বিভাগগুলোর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নয়নের দিক রয়েছে। এলাকার জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা হিসাবে তিনি বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে নিজে ব্যবহার করা, অন্যকে উৎসাহিত করা এবং নিরাপদ খাদ্য বাজারজাতকরণের মাধ্যমে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে সকলের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

IMG_20180603_122947 (1)

কৃষক ইমান আলীর মতে, ‘কৃষি পেশা বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে ধারণ ও বহন করে। তাই সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষকে কৃষি ও কৃষি পেশার সাথে যুক্ত মানুষগুলোকে প্রকৃত মর্যাদা দিয়ে ভালোবাসতে হবে। আন্তরিকতা বৃদ্ধি করতে হবে এ পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কাজের প্রতি। অন্যদিকে যারা এ কাজের সাথে যুক্ত আছেন তাদের বিবেচনায় রাখতে হবে মাটি ও মানুষের কথা চিন্তা করে নিরাপদ খাবার উৎপাদন করার বিষয়টি। তাহলে মানুষের স্বাস্থ্য যেমন ঠিক থাকবে, তেমিন ফিরে আসবে এ পেশাভিত্তিক সচ্ছলতা এবং সেই সাথে বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে মাথা উচু করে দাঁড়াবে বিশ্বের দরবারে।

happy wheels 2

Comments