লোহা পিটিয়ে জীবন চলে

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে বাইশদার গ্রাম। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, পাখিরা ডেকে উঠছে থেকে থেকে। শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ। মাটির রাস্তার দুপাশে নানা ধরণের গাছের সারি। সেই মাটির পথ ধরে কিছুদূর এগুলেই কামার পাড়া। নীরব পরিবেশে হঠাৎ করেই কানে আসে ঠক্ঠক্ আওয়াজ। নিঃশব্দ পরিবেশটাকে ছাপিয়ে চলছে কামারের হাতুড়ি আর হাঁপড়। যেমনি করে মুগুর উঠছে, মুগুর নামছে ভাঙছে মাটির ঢেলা। ঠিক তেমনি করেই হাঁপড় উঠছে, হাঁপড় নামছে গলছে লোহার ঢেলা। এই লোহাকে আগুনে গলিয়ে নানা আকারে তৈরি করা হয় নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী।

বর্তমান আধুনিক যুগে অনেক কিছুই বদলেছে। নিত্য ব্যবহার্য উপকরণ ব্যবহারে শহরাঞ্চলে নতুনত্বের ছোঁয়া লাগলেও গ্রামাঞ্চলে লোহার তৈরি বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার এখনো কমেনি। কারণ কৃষি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজে প্রতিনিয়ত লোহার উপকরণের প্রয়োজন হয়। কৃষি কাজে কোদাল, লাঙ্গল, কাচি/কাস্তে, শাবল, ছেনি/নিড়ানি আর সাংসারিক কাজে দা, বটি, খুন্তি, কুড়াল, চাকু ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। তবে উপকরণ ব্যবহারে পরিবর্তন না এলেও পরিবর্তন এসেছে পেশাজীবীদের। আগে যারা লোহার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাদের এই কাজ এখন বন্ধপ্রায়। কারণ আধুনিক মেশিন বা যন্ত্র ব্যবহার করে এখন লোহার উপকরণ তৈরি করা যায়।

IMG_20190305_123814
বাইশদার গ্রামে এক সময় অনেক পেশার মানুষের বসবাস ছিল। যেমন জেলে, মাঝি, মুচি, নাপিত, কামার ইত্যাদি। বর্তমানে বেশিরভাগ পেশা বিলুপ্ত হওয়ার কারণে সেই পেশাজীবীরা অন্যত্র গিয়ে বসতি গড়েছেন। গ্রামটির পাশেই সাইডুলি নদী। এই নদী পথে একসময় লঞ্চ, স্টিমার, বড় নৌকা যেমন চলাচল করতো, তেমনই নদী পাড় হতো মানুষজন। তাঁদের পারাপার করতেই প্রয়োজন হতো মাঝির। আর নদীতে মাছ ছিল প্রচুর। জেলেরা মাছ ধরতেন। তাই সেখানে মাঝি আর জেলেরা বসতি স্থাপন করে দিনযাপন করতেন। বর্তমানে নদীর দুই পার ভরাট হয়ে গেছে। নদীতে ব্রীজ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া নদী শুকিয়ে গেছে, শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না বললেই চলে। এখন আর আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না, লোকজনও হেঁটে পার হতে পারেন। এ কারণে মাঝি আর জেলে পরিবারের লোকজন নিজ গ্রাম ছেড়ে জীবিকার তাগিদে অন্য জায়গায় চলে গেছেন।

রয়ে গেছে কয়েকটি কামার আর রবিদাস পরিবার। তবে কামার পরিবারের সংখ্যাও এখন কমে গেছে। ১৪টি পরিবারের মধ্যে বর্তমানে ৬টি পরিবার বাস করছে এই গ্রামে। গ্রামে থেকে যাওয়া কামার সম্প্রদায়ের ছেলে সজীব চন্দ্র। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি লোহার কাজ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সজীব ছোট। ঠিক কবে থেকে সজীব লোহা গলিয়ে দা, বটি বানানো শুরু করেছে তা বলতে পারবেন না। ছোট বেলায় যখন বাবা আর বড় ভাই লোহা পেটাতো, তখন সে তাদের পাশে বসে থেকে দেখতো। এখন বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন, সাথে শ্বাসকষ্ট। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বড় ভাইয়ের সাথে এই কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়া। মদনপুর কলেজে বি.এ পড়ছেন।

নিজেদের বসত বাড়ির লাগোয়া সামনের অংশে নিচু করে বানানো ছোট্ট একটি চালা ঘর। এটিকে ঘর বললে ভুল হবে, শুধু চাল আছে। চারদিক খোলা। এই ঘরের মাঝখানে হাঁপড়টি প্রতিনিয়ত হাঁপাচ্ছে আর লোহাতে তাপ দিয়ে যাচ্ছে। ঘরের এক পাশে সুপারি গাছ আর বাঁশ কেটে বানানো হয়েছে বসার জায়গা। এখানে বসেই ক্রেতারা তাঁদের প্রয়োজনমাফিক জিনিসের ফরমায়েশ দিয়ে যান। এটি তাদের পারিবারিক পেশা। চাষযোগ্য জমি নেই। পরিবারের ৭ জন মানুষের সমস্ত চাহিদা পূরণ হয় এই কাজের উপার্জন থেকে।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজের ঘরটিকে পানি ছিটিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে নিজের মতো করে শুদ্ধ করে নেয় সজীব। হাতুড়ি, নিহাই, পাড়ান, রেত, সাঁড়াশি নিয়ে বসে যায় সে। তার পর কয়লাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে শুরু হয় হাঁপড়ে বাতাস দেয়া। আগুনের মধ্যে লোহাকে রেখে গলানো হয়। লোহা যখন পুড়ে লাল হয়ে যায় তখন হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে চাহিদা মতো আকৃতি দেয়া হয়। মাঝে মাঝে জল ছিটিয়ে ঠান্ডা করে নেয়া হয়। চোখের পলকে লোহা হয়ে যায় দা, কুড়াল, খুন্তি।

IMG_20190305_124229_1
কামারদের কাজের প্রধান উপকরণ হলো লোহা আর কয়লা। এগুলো তাদের কিনতে হয়। এক মণ লোহার দাম পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। আর কয়লা কিনতে হয় টিন হিসেবে। এক টিন কয়লা বিশ থেকে ত্রিশ টাকা। সজীব আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম ও হোটেল থেকে কয়লা যোগাড় করে আনে। এখন আর আগের মতো কয়লাও পাওয়া যায় না। কারণ গ্রামের বাড়ি আর হোটেলগুলোতে এখন লাকড়ির পরিবর্তে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে। বিক্রেতারাও সুযোগ বুঝে কয়লার দাম বেশি নিতে চায়।

সপ্তাহের সাত দিনই সজীব ব্যস্ত থাকে লোহা পিটাতে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেকেই নানা রকম জিনিসের বায়না দিয়ে যায়। দা, বটি, কাস্তে, কুড়াল আর কোদালের বায়না আসে বেশি। ধান কাটার মৌসুমে ভাত খাবারও সময় হয় না তার। এর কারণ হলো এ সময়ে কাস্তের চাহিদা থাকে বেশি। পার্শ্ববর্তী গ্রাম মদনপুরে ফাল্গুন মাসে মেলা হয়। এই মেলায় অনেক জিনিসের পাশাপাশি লোহার জিনিস বিক্রি হয়। তাই সজীব অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছু জিনিস তৈরি করে জমা করে রাখেন। তখন তিনি ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন। ফরমায়েশি কাজ ছাড়াও এগুলো তৈরি করে বিভিন্ন হাঁটে নিয়ে যায় বিক্রি করতে। একটা ভালো মানের বটি সাতশ’ থেকে আটশ’ টাকায় বিক্রি করা যায়। তবে গ্রামের ক্রেতারা এত দাম দিয়ে জিনিস কিনতে পারে না। তারা চায় একটু সস্তায় পেতে। তাদের জন্যও সজীব জিনিস বানায়।

এগুলো বিক্রি করে সংসারের চাহিদা অনুযায়ী বাজার করে নিয়ে আসে। তারপর খেয়ে দেয়ে পরের দিন ভোরে উঠার জন্য ঘুমোতে যায়। যে বয়সে ছেলেরা হৈচৈ করে বেড়ায়, সে বয়সে সজীব লোহার জিনিসে শান দেন। কাজের চাপে সে প্রতিদিন কলেজেও যেতে পারেনা। এজন্যই সে গ্রামের কলেজে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন কলেজে গেলে যে তার সংসার চলবে না। তবে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চান তিনি। কারণ শিক্ষিত হলেই যে চাকুরি করতে হবে এমনটি তিনি মনে করেন না। তাদের সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন এই কাজ আর করেন না। চাকরি করেন। অবশ্য তিনি চাকরি করতে চান না। দাদার আমলের পেশাটিকে তিনি ধরে রাখবেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে একটু জমি কিনে চাষ করবেন। আর যদি পারেন বাড়িতে মুরগির খামার করবেন। সজীব গ্রাম ছাড়তে চান না। এখানেই যে তার জন্ম, শৈশব, বেড়ে উঠা।

বড় ভাই বিয়ে করেছেন, তার সংসার হয়েছে। তাছাড়া বাবা অসুস্থ। ডাক্তার বলেছেন অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে তাঁর শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে পারবেন না। আর হাঁপড়ের কাছে যাওয়া তো একেবারেই নিষেধ। বাবার চিকিৎসার খরচও সজীবকেই বহন করতে হয়। সংসারের এত দায়িত্ব এই ছোট বয়সেই তাকে নিতে হয়েছে। তবুও তার এতটুকু ক্লান্তি নেই।

নিজেদের চাহিদা মেটাতে, সময়ের প্রয়োজনে অনেকেই আজ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছেন। গ্রাম ফাঁকা হয়ে গেছে। কিন্তু এই খোলা হাওয়ায় বেড়ে উঠা সজীব পরিশ্রমের কাজ সেরে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারেন। অবসরে নদীতে ঝাঁপাতে পারেন। নিজের হাতে গাছের ফল পেড়ে খেতে পারেন। আর পারেন ঘরের দাওয়ায় বসে মায়ের হাতে ভাজা মুড়ি খেতে। তিনি তার কাজ ভালোবাসেন। তাই অন্যদের মতো এই কাজ ছেড়ে দেবেন না। তিনি মনে করেন যারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে তারা একদিন ঠিক ফিরে আসবেন। তখন আবার সবাই মিলে আগের মতো ঠক্ঠক্ আওয়াজে গ্রামটাকে মুখর করে রাখবে।

happy wheels 2

Comments