নারী আন্দোলনের আলোকবর্তিকা শাহিন আক্তার

মানিকগঞ্জ সিংগাইর থেকে রিনা আক্তার

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘নারীরা হলো পুরুষের জীবনের চার আশ্রমের চার দাতা যেমন: বাল্যকালে মা, যৌবনে স্ত্রী, পৌঢ়ে কন্যা বা পুত্রবধু, বার্ধক্যে নাতনী বা নাতবউ।’ কবির এই বক্তব্যে যর্থাথই বলেছেন, তিনি একজন পুরুষের জীবনে নারীর প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছেন। আমাদের সমাজে নারীদেরকে রাখা হয় অবহেলিত অবদমিত। তাদেরকে রাখা হয় চার দেয়ালে আবদ্ধ। তাদের হাতে, পায়ে পড়ানো হয় শত নিষেধের শিকল। নারীরা শুধু নিজের পরিবারেই নয়; সে সমাজে, এমনকি রাষ্ট্রে ও অবহেলিত। নারী হয়ে জন্ম নেয়াটাই মনে হয় সব থেকে বড় ভুল।

20191005_003925-1

কিন্তু শত নিষেধের শিকল ভেঙ্গে যারা নিজেকে উন্মোচিত করতে পারেন তারাই পৃথিবীতে তাঁদের মহৎ কর্মের স্বাক্ষর রেখেছেন। আমরা বেগম রোকেয়ার কথা সবাই জানি। তিনি তার শৃঙ্খল ছিঁড়ে বের হতে পেরেছিলেন বলেই তিনি আজ নারী জাগরণের অগ্রদুত হিসেবে বিশ্বখ্যাত। নারীদের এই দেয়াল ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে হবে। তবেই জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জিত হবে। এমনই এক নারী যিনি তার জীবনের শত বাধা অতিক্রম করে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হতে পেরেছেন তিনি হলেন অধ্যাপক শাহিন আক্তার। তাঁর বয়স ৫৬ বছর। তিনি পেশায় অধ্যাপক। তিনি মানিকগঞ্জের সিংগাইর সরকারি কলেজে পড়ান। তাঁর স্বামীর নাম মরহুম মওদুদ রহমান ভূঁইয়া। তাদের মেয়ের নাম শাহরিন ভূঁইয়া (দিয়া), বয়স ১৬ বছর। সে এস.এস.সি পরীক্ষার্থী।

20191005_003957-1 - Copy

শাহিন আক্তার ১৯৬১ সালের পহেলা জানুয়ারিতে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার সিংগাইর পৌর এলাকার ৯নং ্ওয়ার্ডের বিনোদপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারটি ছিল নিভৃত পল্লীর মধ্যে তথাপি শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান গরিমায় পরিবারটি ছিল স্বনামধন্য। অভিজাত হিসেবে খ্যাত একটি সুপরিচিত ও উজ্জ্বল পরিবার। তাদের তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট শাহিন আক্তার। জন্মের মাত্র ৩দিন পর তার পিতা ইন্তেকাল করেন এবং ২ বছর বয়সে তাঁর মা তাদের মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে না ফেরার দেশে চলে যান। পিতৃ-মাতৃহীন অবস্থায় তিনি তার পিতামহীর স্নেহ ছায়ায় বড় হন। সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তার স্নেহময়ী পিতামহীও তাকে ছেড়ে চলে যান। তার লালন-পালন ও মানুষ করার দায়িত্ব এসে পড়ে তার বড় ভাই মো: শওকত হোসেনের ্্্ওপর যিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনিই পরবর্তী তাদের দুই ভাই বোনকে মানুষ করে তোলেন। ভাইয়ের আগ্রহ ও প্রেরণায় তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল বিদ্যাপিঠে প্রবেশের সুযোগ লাভ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে সিংগাইর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি এবং সিংগাইর ডিগ্রী কলেজ থেকে ১৯৭৯ সালে কৃতিত্বেও সাথে এইচ এস.সি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনাসর্ (সম্মান)সহ স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও এম.ফিল ডিগ্রী অর্জন করেন।

শিক্ষা জীবন শেষ করে শিক্ষকতা পেশাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সিংগাইর ডিগ্রী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। চাকুরিরত অবস্থায় ল²ীপুর জেলার এক স্বনামধন্য পরিবারের ছেলের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহের নয় মাসের মধ্যে তার গর্ভে তার ভাবী উত্তরাধিকারী বংশধরকে রেখে তাকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তার স্বামী ইহকাল ত্যাগ করেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। পরে তাদের মেয়ে দিয়ার জন্ম হয়।

পরবর্তীতে তিনি এবং তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। জনকল্যাণের মহৎ কর্মযজ্ঞে তিনি তার প্রশান্তি খোজার চেষ্টা করেন। তার স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে তিনি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে তার একটি ফ্লাটে দুঃস্থ নারীদের কল্যানার্থে ‘দুঃস্থ নারী ও কন্যার শাহারা সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেখানে অসহায় দরিদ্র অনাথ নারীদের শিক্ষা দীক্ষার ও জীবন সমস্যার বিভিন্ন সমাধান খুজে তাদের পুনবার্সন ও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেও যাচ্ছেন। কেবল নারী শিক্ষা নয়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্যও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

২০১০সাল থেকে তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা ,সিংগাইর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান হন।এছাড়াও মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একযোগে ৪৯০টি উপজেলায় সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থার অধীনে ‘তথ্য আপা প্রকল্প’ চালু করেছেন এবং উক্ত প্রকল্প উপজেলা শাখারও তিনি চেয়ারম্যান যার কারণে সমগ্র সিংগাইরের নারীদের জন্য কল্যাণকর কিছু করার সুযোগ পেয়ে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন। এছাড়াও তিনি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর গঠিত বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের জাতীয় কমিটির সদস্য এবং জাতীয় কন্যা শিশু এডভোকেসির জাতীয় কমিটির সদস্য।

20191005_004004-1

‘৯০’ এর গণআন্দোলনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রোকেয়া হল শাখার ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করেন। সরকারী সিংগাইর ডিগ্রী কলেজের পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন ্্্এবং তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানে ষ্টাফ ক্্্উান্সিলের সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এছাড়াও তিনি সিংগাইর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। তিনি বাংলাদেশ দূর্নীতি দমন কমিশনের নির্দেশে গঠিত ‘সিংগাইর উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির’ সদস্য পদ লাভ করেন।

তিনি মনে করেন তিনি নারী হওয়া সত্বেও এবং এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও যদি তিনি সমাজের জন্য কল্যাণকর কিছু করতে পারেন তাহলে অন্য নারীরা কেন পিছিয়ে পড়ে থাকবে। তিনি তাদেরকে এগিয়ে আসার আহŸান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি নারী, আমি যদি পারি তবে বাকি নারীরা কেন পশ্চাতে থাকবে’। তাঁর মতে, তিনি যদি দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ এই নারীদের কল্যাণকর পথের সংগ্রামী সৈনিক তৈরি করতে পারেন তবেই তার জীবন সার্থক ও সফল হবে।

happy wheels 2

Comments