ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ফসলের ক্ষতি

শ্যামনগর থেকে পার্থ সারথী পাল

বিগত ১০ নভেম্বর (রবিবার), ২০১৯ এর ভোররাতে বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরও এর কবলে পড়ে, এলাকার উপর দিয়ে মুলত উত্তর-পশ্চিম কোন দিয়ে এ ঝড় আঘাত হানে। প্রচন্ড বেগে বাতাসের সঙ্গে ছিলো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। আগের দিন (শনিবার) হতে এলাকায় হালকা হতে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিলো। তবে যে সময়টি ঝড় আঘাত হানে সময়টি ছিলো ভাটার সময় এবং ভোর হওয়াতে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গাছ উপড়ে পড়ে, মাঠের ফসলে এবং মাছের ঘেরে।

20191113_123741

শ্যামনগর উপজেলার ইশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের অল্পনা রানী মিস্ত্রি একজন কৃষানী, স্বামী-স্ত্রী মিলে চাষাবাদ করেন। চলতি  মৌসুমে তিনি এক বিঘা জমিতে লালশাক এবং পালংশাক চাষ করেছিলেন, শাক উঠার পর জমিতে লাগানোর জন্য ওলকপি, বাধাকপি, ফুলকপি, বীটকপি, টমেটো এবং ঝাল(মরিচ) এর বীজতলা করেছিলেন। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সৃষ্ট অতিবৃষ্টি এবং বাতাসের কারণে শাকক্ষেতে পানি ও কাদামাটি উঠে যায়। কৃষাণীর মতে, শাক এখন ছোট থাকায় তোলাও যাবে না আবার পানি সরে গেলেও শাকের গায় কাদামাটি লেগে থাকবে এবং রোদ পড়লে গোড়া পচে যাবে, তার ধারনা অল্প কিছু শাক তোলা যেতে পরে।

20191113_124739

এ বছর ধারণা করেছিলেন তিনি প্রায় ১০-১২ মণ শাক তুলতে পারবেন এবং শুধুমাত্র শাক বিক্রি করেই প্রায় ১২-১৪ হাজার টাকা আয় করতে পারতেন। এরপর সবজি লাগানোর জন্য যে বীজতলা করেছিলেন তার পুরাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে তিনি প্রায় ১৫০০ টাকার বীজ বপন করেছিলেন। এখন নুতন করে যেহেতু বীজতলা তৈরির কোনো সময় নেই তাই তিনি জমিতে আলু চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও আলু চাষে তিনি আগ্রহী ছিলেন না, কারণে হিসাবে তিনি বলেন এতে খরচ অনেক বেশি কিন্তু বাধ্য হয়ে তিনি এটা করবেন, যেহেতু এখন অন্য কিছু করার সুযোগ ও সময় নেই।

20191113_123625

শীতকালীন সবজি করে তিনি আনুমানিক ত্রিশ হাজার টাকা আয় করতে পারতেন। এছাড়া এবছর তিনি ২১টি শীমজাত নিয়ে এলাকা উপযোগী জাত নির্বাচন বিষয়ে একটি গবেষণা শুরু করেছিলেন তবে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ফলে বেশিরভাগ শীমগাছ নষ্ট হয়ে গেছে এবং মাচা ভেঙ্গে গেছে। ফলের গাছসহ বিভিন্ন গাছেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নারকেল গাছে, গাছের সব কাধি ভেঙে গেছে, কিছু ঝরে পড়েছে, যা গাছে আছে কয়েকদিনের মধ্য নষ্ট হয়ে যাবে। ডাব হিসাবে যেগুলো সম্ভব বিক্রি করে দিবেন বলে ভাবছেন। ফলের অন্যান্য গাছের ডাল ভেঙ্গেছে তবে তার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আশপাশের অনেকের ফলের গাছও পড়ে গেছে।

20191113_124820

কৃষানী অল্পনা রানী মিস্ত্রি অন্যর কাছ হতে জমি লিজ নিয়ে এবছর ৫ বিঘা জমিতে ব্রিধান-৪৯ জাতের ধান চাষ করেছিলেন। জাতটি কিছুটা আগাম হওয়াগে ধান গাছ দুধ অবস্থায় ছিলো। এমন সময়ে ঝড়ের কবলে পড়ার কারনে বেশীরভাগ ধানই চিটা হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করছেন। এবছর তিনি আশা করছিলেন জমি হতে প্রায় ১০০ মন ধান পাবেন কিন্তু তার অর্ধেকও এখন পাবেন কিনা সন্দেহ আছে। তার আশপাশে অন্যান্য কৃষক বিআর-১০ এবং বিআর-৩০ জাতের ধান লাগিয়েছে, এগুলো কিছু ফুল, কিছু থোড় অবস্থায় রয়েছে, এগুলোও সমান ক্ষতি হবে। তবে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যায় যে, এবছর বৃষ্টিপাত দেরীতে শুরু হওয়ার ফলে এলাকাতে আমন মৌসুমের ধান কৃষক এক-দেড়মাস পরে রোপন করে। একারনে অনেক স্থানের ধানে এখনও ফুল আসেনি, এগুলো কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তবে কাইচথোড় অবস্থায় আঘাত লাগায় কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। অনেক জায়গায় ধান গাছ পড়ে গেছে এবং কিছু জায়গায় ধান গাছের উপর শেওলা উঠে নষ্ট করেছে। কৃষাণী অল্পনা রানী পাচ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন। তিনি ধারণা করছেন ধান পেতে পারেন ৫০ মণ। কিন্ত বুলবুলের কারনে ক্ষতি হবে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা। এলাকার সকল কৃষকের কম-বেশি একই ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কৃষানী অল্পনা রানী মিস্ত্রির দশ কাঠার একটি পুকুর রয়েছে। এখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করেন, তবে বেশীরভাগ দেশী প্রজাতীর মাছই তিনি সংরক্ষণ করেন। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পরের দিন হতে তার পুকুরের সব ধরনের মাছ মরা শুরু করে। পুকুরের মরা মাছের ভিতর রয়েছে কই, তোড়া, পুটি, শোল, টাকি, রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, টেংরা, লাঠা, সিলভারকার্প, বাটা, মরখুল্লা, চেলা ইত্যাদি। মাছ মরার কারণ হিসাবে আশপাশের ঘোলা-ধোয়নী পড়া এবং বাতাসের তোড়ে পানিতে আঘাত লাগার কথা বলেন। মরা মাছ তুলে চুন প্রয়োগ করেছেন কিন্তু এখনও মাছ মরা কমেনি। জলে গন্ধ হয়ে গেছে, গোসল করাও যাচ্ছে না, এ পুকুরের পানি রান্নার কাজে ব্যাবহার করা হতো তাও করা সম্ভব হচ্ছে না।

20191113_125058

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে উপকূলের ২ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল ঝড়ের কবলে পড়েছে। ফসল নষ্ট হয়েছে ২-৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, খুলনা ও পটুয়াখালী জেলায়। এসব জমিতে মাঠগুলোতে মূলত শীতকালীন সবজি ছিল। মুলা, ফুলকপি, বাধাকপি, শাকসহ অন্যান্য সবজির বেশিরভাগ প্রায় ছিলো বিক্রয়যোগ্য অবস্থায়। পর্যায়ক্রমে মাঠ থেকে তোলা হচ্ছিলো। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের নুতন করে ঐ সব সবজি চাষের সুযোগ নেই এবং তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে। প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান, ৮০০ হেক্টর সবজি, ৫০০ হেক্টর সরিষা ও ১২০ হেক্টর জমির পান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (প্রথম আলো, সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, ১২/১১/২০১৯)।

20191113_130021

শ্যামনগর কৃষি অফিসের তথ্য অনুসারে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে এলাকায় আমন মৌসুমে চাষকৃত ১৬,৮০০ হেক্টর জমির ধানের ভিতর ১০ শতাংশ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ২০০ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসলের মধ্য ৫০ শতাংশ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

happy wheels 2

Comments