সাম্প্রতিক পোস্ট

প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশে যুব সংগঠন

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
সকল পেশা, সকল শ্রেণী ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়েই আমাদের এই সমাজ। সকলের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শ্রম ঘামের উপর ভর করেই আমাদের এ সভ্য সমাজটা দাঁড়িয়ে আছে। সমাজে বাস করেন কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, হরিজন, মাঝি, কবিরাজ, প্রবীণ, যুব, ভিন্নভাবে সক্ষম (প্রতিবন্ধী) ও সকল প্রকার প্রাণসম্পদসহ সকল জীব ও উদ্ভিদ। সকল কিছুর সমন্বয়ে ও পারস্পারিক আন্তঃসম্পর্ক ও নির্ভরশীলতায় আমরা ঠিকে আছি। সকলকে সম্মান ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে পারস্পারিক জীবনধারাকে চলমান রাখতে হবে আমাদের। নেত্রকোনা সদর উপজেলা মদনপুর ইউনিয়নের সবুজ ছায়াঘেরা নিবিড় একটি গ্রামের নাম মনাং।


এলাকার কৃষি কেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষাণীদের নেতৃত্বে এলাকায় ফসল বৈচিত্র্য বৃদ্ধি, শিমের জাত বৈচিত্র্য বৃদ্ধি, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জ¦ালানি সাশ্রয়ী চুলা তৈরি ও ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন নিঃস্বরণ হ্রাসকরণ, বিষয়ভিত্তিক সচেতনতামূলক আলোচনা ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার আদায়ে প্রচারণা, পাখি সংরক্ষণ, শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, এলাকার উন্নয়নে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ, এলাকার দরিদ্র নারীদের সহায়তা করা, সামাজিক অসমতাগুলো দূরীকরণে গ্রামের ২০ জন যুবক ও ২০ জন কৃষাণীদের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘সবুজ পাতা যুব সংগঠন’ ও ‘কুসুমকলি কৃষাণী সংগঠন’ নামে দু’টি স্বেচ্ছাসেবী জনসংগঠন।


মনাং গ্রামে শিশু, নারী ও প্রবীণসহ মোট ৩৫ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা প্রদানের জন্য পাশের গ্রাম সাজিউড়ায় একটি প্রতিবন্ধী স্কুলও রয়েছে। যুব সংগঠনের যুব সদস্যরা উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদে যোগাযোগ করে গ্রামের ১০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য কার্ড করে দিয়েছে। সংগঠনের সদস্যরা জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন অফিসের যোগাযোগ করে ৭ জন প্রতিবন্ধি শিশুকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। শুধু তাই নয় সংগঠনটি প্রতিবন্ধি শিশু শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা উপকরণ (বই, খাতা, কলম ও স্কুল ড্রেস) দিয়েও সহযোগিতা করেছে। এলাকার অতি দরিদ্র প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যারা এই প্রচন্ড শীতে শীতবস্ত্রের অভাবে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে এমন ২০০ জনের সন্ধান পয়। যুব সংগঠনটি গ্রামের কৃষাণী সংগঠন ও পার্শ্ববর্তী ফচিকা গ্রামের অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের সাথে যৌথ উদ্যোগে দরিদ্র প্রতিবন্ধি ব্যক্তি ও প্রবীণ ব্যক্তিদের শীত নিবারণের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।


সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনটি জনসংগঠন এলাকার ৫০ জন প্রতিবন্ধি ও ১৫০ জন প্রবীণ ব্যক্তিসহ মোট ২০০ জনের জন্য একটি করে মোট ২০০টি শীতবস্ত্রের (কম্বল) সংস্থান করে বিতরণের উদ্যোগ নেয়। সংগঠনের সদস্যরা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী চাঁদা দিয়ে এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও দাতাদের নিকট থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে ২০০টি শীতবস্ত্র (কম্বল) ক্রয় করে। সংগঠনের সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে ৬ জানুয়ারি ২০২০ রোজ সোমবার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, শিক্ষক, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিতে সাজিউড়া প্রতিবন্ধী স্কুলে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এসব শীতবস্ত্র ২০০ জন প্রতিবন্ধি ও প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শীতবস্ত্র বিতরণের পূর্বে অনুষ্ঠানটি উপলক্ষে এক আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি মো. আজিজ মিয়ার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ মিয়া।


আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদ মিয়া এলাকার দরিদ্র প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণে এলাকার তিনটি জনসংগঠনের (যুব, কিশোরী ও কৃষাণী সংগঠন) সদস্যদের মহৎ উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আজ তাদের গৃহীত উদ্যোগের ফলে এলাকার ২০০ জন অসহায় জনগোষ্ঠী প্রচন্ড শীত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। আমরা মানুষ হিসেবে পরস্পরের সাথে থাকতে চাই, সকল জাতের মানুষকেই আমাদের ভালবাসতে হবে। প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরও সমাজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। আমি যুব, কিশোরী ও কৃষাণী সংগঠনের এ উদ্যোগের প্রশংসা না করে পারছি না। সংগঠনগুলো আজকে প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে তা খুবই ভালো ও প্রশংসনীয়। এ থেকে আমরা সকলে শিক্ষা নিতে পারি। আমি সব সময় এধরণের উদ্যোগ বাস্তবায়নকে উৎসাহিত করি এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করি।’ তিনি এলাকার বিত্তশালী ও স্বচ্ছল ব্যক্তিদেরকে তাদের অব্যবহৃত শীতবস্ত্রগুলো যত্ন করে সংরক্ষণ করে শীত মৌসুমে জনসংগঠনগুলোকে দেয়ার আহবান জানান।


ফচিকা অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের প্রতিনিধি শেফালী আক্তার তিনটি জনসংগঠনের এই মহৎ উদ্যোগটি বাস্তবায়নে আর্থিক ও শীতবস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার জন্য সংগঠনের সদস্য, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, বারসিক ও এলাকার জনগোষ্ঠীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমরা যুব ও কিশোরী সংগঠনের সদস্যরা নিজেরাই পিতামাতার উপর নির্ভরশীল। আমাদের এলাকার উন্নয়নে ও জনগোষ্ঠীর সেবা করার মানসিকতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণে তা করতে পারিনা। আমরা টিফিন ও হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে কিছু কিছু সঞ্চয় করে এধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, এলাকার স্বচ্ছল ব্যক্তি/পরিবার ও বারসিক’র কাছ থেকে সাহযোগিতা নিয়ে আজ ২০০ জন প্রবীণ ও প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের শীত নিবারণে শীতবস্ত্র দিতে সক্ষম হচ্ছি। আজ আমাদের এলাকার তিনটি জনসংগঠনের উদ্যোগে দরিদ্র প্রবীণ ও প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের জন্য শীতবস্ত্র দিতে পেরে আমার খুব ভাল লাগছে। আমরা সংগঠনের উদ্যোগে আরও এধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।’
সবুজপাতা যুব সংগঠনের প্রতিনিধি আবু আল-ফয়সাল বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন শখ করে মোবাইল ফোনে ফেইসবুকের জন্য এমবি কিনে এবং বিলাসিতা করে অনেক টাকা অপচয় করে থাকি। কিন্তু আমরা একটু মিতব্যয়ী হয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করে তা দিয়ে শীতবস্ত্র কিনে এবং আমাদের ব্যবহৃত পুরনো কাপড়গুলো যত্নে সংরক্ষণ করে রেখে শীত মৌসুমে গ্রামের দরিদ্র লোকদের দিয়ে তাদের শীত নিবারণে সহযোগিতা করতে পারি। এই সামান্য ত্যাগস্বীকার করেই আমরা দরিদ্র লঅকদেরকে প্রচন্ড শীত থেকে কিছুটা রক্ষা করতে পারি।’ তিনি সকলকে তাদের পুরানো ও ব্যবহার উপযোগি কাপড়গুলো ফেলে না দিয়ে সংগঠনে দিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।

আমাদের দেশের সকল এলাকাতেই অসংখ্য যুব ও কিশোর-কিশোরী রয়েছে যারা লেখাপড়া ছাড়া তেমন কোন কাজের সাথে জড়িত নয়। তারা শখের বসে প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে প্রতিদিন অনেক টাকা মোবাইল ফোনে ফেইসবুক ও ইন্টারনেটের জন্য এমবি কিনে ব্যয় করে থাকে। আবার অনেক স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়ে রয়েছে যারা শীতের কাপড় এক মৌসুমের বেশি ব্যবহার করেনা। প্রতি বছর তারা নতুন নতুন শীতের কাপড় কেনে। এসকল যুব, কিশোর-কিশোরী, শিশু ও ব্যক্তিরা তাদের ব্যবহৃত শীতের কাপড়গুলো পরবর্তী মৌসুমের জন্য সংরক্ষণ করে রেখে শীতের শুরুতে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করলে বা কোন সংগঠনে দান করলে সেগুলো দিয়ে অনেক দরিদ্র জনগোষ্ঠী শীত নিবারণ করতে সক্ষম হবে। তাই আসুন আমরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রামের প্রতিবেশি দরিদ্রদের শীতবস্ত্র বিতরণ করি এবং আর্থ মানবতার সেবায় শরিক হই। এলাকায় গড়ে ওঠা জনসংগঠনগুলোকে তাদের গৃহীত মহৎ উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে উন্নয়ন কর্মকান্ডের অংশিদার হই।

happy wheels 2