নারীদেরকে ন্যায্য মজুরি প্রদান করুন

মানিকগঞ্জ থেকে রিনা আক্তার
‘বিশ্বে যা কিছুুুুুুুুুুু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার এই কবিতায় যথার্থই বলেছেন। তিনি পুরুষের জীবনে নারীর অবস্থানকে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। সভ্যতার অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে নারী ও পুরুষের সমান অবদান অনস্বীকার্য। নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের একক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নের কথা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এ নারীরা অবহেলিত ও শোষিত হয়ে আসছে।


পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থায় সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামী, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে নারীরা তাদের অধিকার বিসর্জন দিয়ে আসছেন। নারীরা তাদের প্রতিভার বিকাশ ও আত্মপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ থেকে ক্রমে বঞ্চিত হচ্ছে। নারীকে পূর্ণ মর্যাদা প্রদান, তার মেধা ও শ্রমকে শক্তিতে রূপান্তর করে এবং তার স্ব-নির্ভরশীলতাকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র নির্বিশেষে সারা বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। নারীরা আজকে বিশ^কে নতুনত্ব এনে দিয়েছেন। নারীরা আজ ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ করছেন। কিন্তু নারী-পুরুষ এক সাথে কাজ করলেও তাদের মধ্যে রয়েছে মজুরির অসমতা। তাদেরকে তাদের প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। টিয়া বেগমও সেই বঞ্চিত নারীদের দলে রয়েছেন; প্রাপ্য মজুরি থেকে তিনিও বঞ্চিত।


মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার ঘোনাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা টিয়া বেগম (৪০)। এক ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে টিয়া বেগমের সংসার। তার স্বামীর নাম আব্দুল রব (৫৫) । তিনি পেশায় একজন কৃষক। তার ছেলের নাম রবিন (২৮) এবং মেয়ের নাম রকসি (১৫)। রকসি নবম শ্রেণীতে পড়াশুনা করে । রবিন পেশায় একজন ট্রাক ড্রাইভার, তিনি বিয়ে করে আলাদা থাকেন। তার বাবা- মা আর ছোট বোনের খরচ তিনি আর বহন করেন না।


টিয়া বেগম তার মেয়ের লেখাপড়া এবং পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য ভাবতে থাকে কি করা যায়। কেননা তার স্বামী যতটুকু আয় করেন তাতে তাদের সংসার চালানোই কঠিন, অন্যদিকে মেয়ের লেখাপড়া খরচ কিভাবে চালাবেন? এভাবেই তিনি নানান বিকল্প নিয়ে চিন্তা করেন। তিনি বিভিন্ন কাজের সন্ধান করতে থাকেন। এক সময় সে রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজের খোঁজ পান । যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়েই কাজ করেন।
এছাড়াও রাজমিস্ত্রীর কাজ করায় অনেকেরই অনেক কটু কথার মুখেও পড়তে হয় তাকে। একজন মানুষ না খেয়ে থাকলে তাকে দেখার কেউ নেই কিন্তু কটু কথা বলার মানুষের অভাব নেই। শত কটু কথা ও অবহেলার মধ্য দিয়েই তিনি কাজ করেন।


একজন যোগালিকে কাজ করতে হয়- ইট, সিমেন্ট, বালি বহন থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজও তাকে করতে হয়। এ কাজে যোগালি একজন মিস্ত্রির চাইতেও তিন গুণ বেশি কাজ করেন । মিস্ত্রি রোজ পারিশ্রমিক পান ৮০০ টাকা, পুরুষ যোগালি পায় ৫০০ টাকা, সেখানে নারী যোগালি পান মাত্র ৩০০ টাকা । কাজ করেও সঠিক মজুরি পান না টিয়া বেগম। দিন শেষে কাজ করে কম টাকা পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। তাঁর পরিবারে যেন নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। সারাদিন কাজ করে যে টাকা তিনি আয় করেন তা দিয়ে সংসারই চলে না! উপরোন্তু মেয়ের লেখাপড়ার খরচ! তিনি বলেন, ‘ক্যান যে মাইয়া হইলাম, মাইয়া দেইখ্যায় সবার বোঝা হইলাম।’


উল্লেখ্য যে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হরহামেশাই নারীরা সকল কর্মক্ষেত্রে বিশেষ করে কারখানাসহ শ্রমনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি বঞ্চনার শিকার হন। মজুরি ছাড়াও তারা বিভিন্ন যৌন হয়রানীর মত শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হন। শুধু টিয়া বেগম নন; সমাজে অনেকেই আছেন যারা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হন এবং বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হন। বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হওয়ার পরও কাজের সুবাদে তারা অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো মুখ বুজে সহ্য করেন। আমরা এই সকল বঞ্চনা ও নির্যাতনের অবসানসহ কর্মক্ষেত্রে সম মজুির নিশ্চিতকরণের দাবি জানাই।

happy wheels 2

Comments