সুপেয় পানির উৎসগুলো রক্ষা ও সংরক্ষণে সবাই এগিয়ে আসি

সিলভানুস লামিন

এক
পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ হচ্ছে পানি। অথচ পানযোগ্য পানির পরিমাণ অতি অল্প। পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ২.৫ ভাগ মিষ্টি। এর মধ্যে ৬৮.৯ ভাগের অবস্থান তুষারে, ০.০০৯ ভাগের অবস্থান লেক ও নদীতে এবং ২৮ ভাগের অবস্থান ভূ-অভ্যন্তরে। মিষ্টি পানির ২৩ ভাগ শিল্পোৎপাদনে, ৬৯ ভাগ কৃষি উৎপাদনে এবং ৮ ভাগ গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহার হয়। বিশ্বের মোট পানি সম্পদের মাত্র ০.০২৫ ভাগ পানি পানযোগ্য। জাতিসংঘের জনসংখ্যা সংক্রান্ত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ৪৮টি দেশে বসবাসকারী ২৮০ কোটিরও বেশি মানুষ পানির অভাব সন্মূখীন হবে। ২০৫০ সালে এ ধরনের দেশের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৩টিতে এবং পানির অভাবে থাকা মানুষের সংখ্যা হবে ৪০০ কোটি (সূত্র : সুপেয় পানির সন্ধানে, শেখ সেলিম আখতার স্বপন ও মো. মনিরুল মামুন, জুন, ২০০৪)। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৭৮৫ মিলিয়ন মানুষ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত কিংবা সুপেয় পানিতে প্রবেশাধিকার নেই। অন্যদিকে যারা এ সুপেয় পানিতে প্রবেশাধিকার আছে তারাও নানানভাবে সমস্যাগ্রস্ত। এর কারণ এ সুপেয় পানির অপর্যাপ্ততা। তাদের দৈনন্দিনের পানি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। পৃথিবীর বিশাল পানির মধ্যে মাত্র .০২৫ ভাগ সুপেয়। অথচ নানানভাবে মিষ্টি পানির উৎসগুলোকে দূষিত করা হচ্ছে। শিল্পকারখানা, কৃষি এবং নগরায়ণ সংক্রান্ত বিভিন্ন কমযজ্ঞগুলোই মিষ্টি পানির এ উৎসগুলোকে দূষিত করেছে। অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানি হচ্ছে পৃথিবীর মোট মিষ্টি পানির তিনভাগের এক ভাগ। এই উৎস থেকে আমরা নিত্য প্রয়োজনীয় ৩৬% পানি ব্যবহার করি। কিন্তু এই উৎস থেকেও পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে। কারণ সেচের জন্য নানানভাবে ভূ-গর্ভস্থের পানি তোলা হচ্ছে। এছাড়া, প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে নানাভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন হচ্ছে। ফলশ্রæতিতে দিনকে দিন পানির সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এ পানি সঙ্কট মোকাবিলায় প্রতিবছরই ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালন করা হয়। দিবস পালনের মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার ও পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো রক্ষা ও সরক্ষণের জন্য নানানভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। ২০২০ সালের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন’। পানির প্রাপ্যতার সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি যোগসূত্র রয়েছে।

দুই
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পানির প্রাপ্যতার একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানান আপদ দেখা দেয়। সেই আপদের মধ্যে খরা, বৃষ্টিপাতহীনতা অন্যতম। বৃষ্টিপাত কম হলে স্বাভাবিকভাবেই ভূগর্ভস্থ ও ভূÑঅপরিস্থ পানির ওপর প্রভাব পড়ে। কারণ ন্যুনতম যে পরিমাণ পানি রির্চাজ হওয়ার কথা সেই পরিমাণ পানি রিচার্জ না হয় না। ফলশ্রুতিতে পানির সঙ্কট দেখা দেয়। আমাদের দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছরই পানি সঙ্কট দেখা দেয় কম বৃষ্টিপাত ও খরার কারণে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি আপদ হচ্ছে লবণাক্ততা। নানানভাবে এই লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে; বন্যা ও জলোচ্ছ¡াস হলে সেই লবণাক্ততা মিষ্টি পানির উৎসকে দূষিত করে। ফলে পানির সঙ্কট দেখা দেয়। আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকায় এই সঙ্কটটি দিনকে দিন প্রকটাকারে দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরির্বতনজনিত কারণে কৃষির জন্য, গৃহস্থালী কাজের জন্য, শিল্পকারখানার জন্য এবং মানুষের পানের জন্য আজ সর্বত্রই পানি সঙ্কট অনুভূত হচ্ছে। অথচ বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ পানির আধারগুলোর দূষণ, দখল এবং ভরাট এখনই হরহামেশাই হচ্ছে! আমাদের দেশে বিভিন্ন এলাকার নদী, খাল, বিল ও জলাভূমি দূষণ ও দখলের চিত্রগুলো প্রতিদিনই পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে বা হচ্ছে। দখল ও দূষণ হচ্ছে প্রায় প্রতিটি নদী। সরকার নদীকে একটি ‘জীবনসত্তা’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পরও আজও পানির উৎস তথা নদী, খালবিল ও জলাভূমির দখল বাণিজ্য কমেনি। তাই তো দেখা যাচ্ছে, শীতলক্ষা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা, সিলেটের সারি, মনু, কিংবা নেত্রকনোর মগড়াসহ দেশের আনাচে কানাচে নদীগুলো দখল ও দূষণ হচ্ছে। এসব নদীর পানিগুলো প্রায়ই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাসায়নিক কৃষি, উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের কারণে লবণাক্ততা, দেশের অসংখ্য জেলায় আর্সেনিক দূষণ, নদীর তীরবর্তী ও নদী পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদীর গর্ভে শিল্পকারখানার বর্জ্যসহ অন্যান্য মানব সৃষ্ট বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে আজ বাংলাদেশে পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে। এই সঙ্কটটা মার্চ-এপ্রিল মাসে বেশি পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য কোন কোন এলাকায় বছরব্যাপীই পানি সঙ্কট দেখা দেয়।

তিন
অন্যদিকে পানি সঙ্কটের মূলে পানি সম্পদের বা আধারের স্বল্পতার পাশাপাশি পানির অব্যবস্থাপনাও একটি বড় কারণ। সুপেয় পানি সম্পদের উৎসগুলোকে দূষণ পানি সমস্যা সৃষ্টি করছে। এমনিতেই পানি সম্পদ অপ্রতুল এবং জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে যদি প্রাপ্য পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা না হয় তাহলে পানি সঙ্কট তো দেখা দেবেই। এছাড়া পানি অব্যবস্থানার পাশাপাশি পানির সুষম বণ্টনও একটি সমস্যা যা পানি সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১২% মানুষ ৮৫% ভাগ সুপেয় পানি ব্যবহার করে এবং এই ১২% মানুষ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে বাস করে না। পানি সঙ্কটের মূল কারণই হচ্ছে ক্ষমতা, দারিদ্র্যতা, অসাম্যতা; সুপেয় পানির আধারগুলোর স্বল্পতা নয়। বিশ্বের ১.৮ বিলিয়ন মানুষ দৈনিক ২০ লিটারের কম পানি ব্যবহার করে অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের মানুষ দৈনিক ৫০ লিটার পানি ব্যবহার করে শুধুমাত্র টয়লেটের ফ্ল্যাশ করার জন্য। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ দৈনিক ৬০০ লিটার পানি ব্যবহার করে। উন্নয়নশীল এবং তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরাই সবচে’ বেশি পানি সঙ্কটে ভুগলেও কোকাকোলার মতো বহুজাতিক কোম্পানির পানীয় উৎপাদনের জন্য তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশের পানি সম্পদ ব্যবহার করে। এভাবে দেখা যায়, পানি সঙ্কটের মূলে বৈশ্বিক রাজনীতিও জড়িত। এই বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে পানি ব্যবহারে বিভিন্নভাবে বৈষম্য দেখা দিয়েছে। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনুন্নত ও উনয়নশীল দেশগুলোর মানুষ সুপেয় পানি ব্যবহার থেকে বেশি বঞ্চিত। তাই তৃতীয় বিশ্ব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুপেয় পানি সঙ্কট মোকাবিলায় সুপেয় পানির উৎস রক্ষার পাশাপাশি সুষ্ঠু পানিব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

চার
একবিংশ্ব শতাব্দীতে এসে বিশ্বের জনসংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তবে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা বেড়েছে কিন্তু ৬ গুণ। আগামী ৫০ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা আরও ৪০ থেকে ৫০% বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব বর্ধিত জনসংখ্যার জীবন-জীবিকা ও আবাসনের জন্য শিল্পায়ন ও নগরায়নের হারও যে সমানতালে বৃদ্ধি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য যেমন বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে হবে ঠিক তেমনিভাবে তাদের সুন্দর, সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য শক্তি তথা জ্বালানিরও সমান প্রয়োজন পড়বে। পানির প্রাপ্যতা যেমন শক্তির সহলভ্যতাকে নিশ্চিত করবে তেমনিভাবে শক্তির সহজলভ্যতা বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাপনা, ব্যবহার, পরিশোধন, পরিবহন ও সরবরাহকেও নিশ্চিত করবে। সারাবিশ্বে আজ পানির সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে। পানি সঙ্কটের কারণে শক্তির উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ প্রতিটি শক্তির উৎপাদন, পরিশোধন ও ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তাই বৈশ্বিক পানি সঙ্কট মোকাবিলায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে তরান্বিত করে এমন কর্মযজ্ঞ সম্পাদন থেকে আমরা বিরত থাকি। বন উজাড়, নদী দূষণ, দখল এবং কার্বনভিত্তিক জীবন-জীবিকাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন যত দ্রæত হবে ততবেশি সুপেয় পানির উৎসগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। পানি সঙ্কট মোকাবিলায় তাই শুধুমাত্র পানির উৎস দূষণ ও দখল বন্ধ করলে চলবে না; সাথে সাথে আমাদের জীবনযাত্রায় যাতে কম কার্বন নিঃসরণ করি সেদিকেও সমান নজর দেওয়া উচিত।

happy wheels 2

Comments