কোল আইল ধান চাষে পানি সংরক্ষণ করে

বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
ভূমিকা
বরেন্দ্র অঞ্চল ভৌগলিকভাবেই পানি সংকটপূর্ণ একটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি এই অঞ্চলের জমিগুলোও উঁচুনিচু। এ অঞ্চলের এক জমি থেকে আরেক জমি ছয় থেকে দশ ইঞ্চি পর্যন্ত উঁচু নিচু হয়ে থাকে। ফলে ফসলের জমিতে পানি ধরে রাখা কৃষকের জন্য একটি কষ্টসাধ্য কাজ। অতীতে এ অঞ্চলে শুধুমাত্র বৃষ্টিনির্ভর আমন চাষ হতো। তখন ধান চাষে তেমন সমস্যা না হলেও অনেক জমিই পতিত থাকত। এ অঞ্চলে ইরিধান বা সেচনির্ভর ধান চাষ শুরু হয় ১৯৬৮ সাল থেকে তবে তা ব্যাপক আকারে শুরু হয় ১৯৭৫ সালের দিকে। পাশাপাশি সময়ে ১৯৮৫ সাল থেকে বিএডিসি গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম শুরু করেন। এরপর ১৯৯২ সাল থেকে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁর ২৫টি উপজেলা নিয়ে বিএমডিএ গভীর নলকূপের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে সেচ কাজ শুরু করেন। মূলত গভীর নলকূপের পানির প্রাপ্যতার উপর ভিত্তি করেই এ অঞ্চলের মানুষ সেচনির্ভর ধান চাষে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুদ কমতে থাকে। নেমে যেতে থাকে পানির লেয়ার। বাড়তে থাকে পানির দাম। বাড়তে থাকে সেচ সংকট। কৃষকরা সম্মুখিন হয় নতুন নতুন সমস্যার। প্রাকৃতিক পানি পরিণত হয় ব্যবসায়িক উপাদানে।

পরিচিতি
আইল সম্পর্কে আমরা জানি যে, এটি একটি জমির চারপাশের সীমারেখা। এখানে কোল আইল বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘জমির নিদিষ্ট আইলের বাঁ পাশ দিয়ে হাত দ্বারা নির্মিত অন্য নতুন একটি আইল, যা ধান, আলুসহ যে ফসলে বেশি পানির প্রয়োজন এমন ফসলের জমিতে ব্যবহার করা হয়। এ আইলটি ফসল সংগ্রহ করার পরপরই আবার ভেঙ্গে ফেলা হয়। মূল আইলের পাশেই এর অবস্থান বলে একে কোল আইল বলা হয়।

পানি সংরক্ষণে কোল আইল
বিগত ৫-১০ বছর থেকে রাজশাহী জেলার তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষকদের কাছে ফসল চাষে পানি সমস্যা একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। জমিতে পানি নিতে হলে ধরতে হয় লম্বা লাইন। আবার সময়মত পানিও পাওয়া যায় না। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো আছেই। আর এসব সমস্যাকে বিবেচনা করেই কৃষক নিজের মেধা দ্বারা উদ্ভাবন করেছেন এমন একটি পদ্ধতি যাতে প্রচলিত বোরো ধান চাষে ৩-৪টি সেচ কম প্রয়োজন হয়। এই অঞ্চলের জমি উঁচুনিচু হওয়ার কারণে উপরের জমি থেকে পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমে যায়। ফলে জমি পানিশূন্য হয়ে পরে। কোল আইল সেই পানিকে চুঁইয়ে নামতে দেয় না। ফলে পানি সংরক্ষণ হয়। সেচ সংখ্যা কমিয়ে দেয়।

কোল আইল সম্পর্কে তানোর উপজেলার গোকুল-মোথুরা গ্রামের শ্রী জীতেন্দ্রনাথ সূত্রধর(৫৫) বলেন, ‘আমাদের এলাকায় বোরো ধান চাষে জমিতে সেচের পানি জমি রাখা একটি অন্যতম কাজ। ধানের চারা লাগানো থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত জমি ভেদে ১০-১২ বার সেচের প্রয়োজন হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু আমাদের জমিগুলো উঁচু নিচু তাই কোল আইল ব্যবহার করলে ৭-৮টি সেচেই ধান কাটার মত অবস্থায় চলে আসে। শুধু পানি সংরক্ষন নয় কোল আইলের রয়েছে অনেক উপকার।’ এ বিষয়ে একই উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘কোল আইল ব্যবহার করলে মূল আইলের পাশে আগাছা হয় না বলে আনেক রোগ, পোকার আক্রমণ হয় না। জমি পরিষ্কার রাখতে সহযোগিতা হয়। আবার মূল আইল দীর্ঘস্থায়ী হয়। ধানের জমির পাশে অন্য ফসল থাকলেও পানি চুঁইয়ে যায় না বলে অন্য জমির ফসলেরও ক্ষতি হয় না।’ অন্য ফসলে কোল আইল ব্যবহার সম্পর্কে মোহর গ্রামের শ্রী খীতেন্দ্রনাথ (৬৫) বলেন, ‘আলু চাষের ক্ষেত্রে অসময়ে জমিতে পানি প্রবেশ অনেক ক্ষতির কারন হয় কিন্তু কোল আইল দেওয়ার কারণে অন্যর জমি বা মূল ড্রেন থেকে পানি প্রবেশ রোধ করে। ফলে আমাদের যখন প্রয়োজন তখনই আলুর জমিতে সেচ নিতে পারছি।’

কৃষকের মেধা ও প্রচেষ্টায় ছোট্ট একটি পদ্ধতি তাঁদের সমস্যা মোকাবেলায় কতটা কার্যকর হতে পারে কোল আইল একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে। কোল আইল ব্যবহারের ফলে জমিতে পানি সেচ কম প্রয়োজন হচ্ছে যার কারণে মাটির নিচ থেকে পানিও তুলতে হচ্ছে কম। সে হিসেবে কৃষকরাই প্রকৃতি সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে তা আমরা বলতেই পারি।

happy wheels 2

Comments