করোনাকাল, লোকজ্ঞান ও প্রকৃতির বিজ্ঞান

ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ

করোনাকালে আবারো স্পষ্ট হয়ে ওঠছে লোকজ্ঞান ও প্রকৃতির শক্তি। কিন্তু অধিপতি পাটাতনে এই জ্ঞানভাষ্য অস্বীকৃতই থেকে যাচ্ছে। কারণ কী? লোকায়ত জ্ঞানের সাথে বিদ্যায়তনিক বাহাদুরির ঐতিহাসিক বিরোধ? নাকি এখনো বড় হয়ে থাকছে নির্দয় শ্রেণিপ্রশ্ন? ঐতিহাসিকভাবেই অসুখ ও মহামারী সামালে গ্রাম-বাংলায় গড়ে ওঠেছে নানা লোকভাষ্য, বিজ্ঞান ও সুরক্ষাবিধি। কলেরা থেকে কালাজ্বর কী বসন্তের সেইসব কাল সামাল দিতে লড়েছিল গণমানুষের বিজ্ঞানশক্তি। অথচ এই করোনারকালে আমরা সেইসব লোকায়ত প্রচেষ্টাগুলোকে একত্র করতে পারিনি। সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন বা ঘরবন্দি এবং লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা। করোনা মোকাবেলায় এখনো এই তিনটি বিষয়ই বৈশ্বিকভাবে মানছে সবাই। মহামারী বা কঠিন অসুখ মোকাবেলায় এই পদ্ধতিগুলোই তো ঐতিহাসিকভাবে লোকায়ত জ্ঞানের উদ্ভাবন। এককভাবে কোনো মানুষ বা প্রতিষ্ঠান নয়, এসবের চল শুরু হয়েছিল সামষ্টিকভাবে মানুষের লোকায়ত জীবনের যৌথতায়। এখনো এর টাটকা প্রমাণ বয়ে চলেছে অনেক সমাজ।

মহামারী মোকাবেলার লোকবিজ্ঞান
এই যে বলা হচ্ছে মানুষ লকডাউন মানছে না, সঙ্গনিরোধ করছে না। কিন্তু কারা মানছে না একবার কী তলিয়ে দেখা যায়? দেশের গরিষ্ঠভাগ আদিবাসীরাই কিন্তু মানছে এই লকডাউন ও সঙ্গনিরোধ। এইসব শব্দ অনেক গ্রাম কী পাড়ায় পৌঁছানোর আগে থেকেই নিজেরা এই সুরক্ষাবিধি তৈরি করেছে নিজেদের মত করেই। ব্যক্তি নয়, মহামারী মোকাবেলাকে লোকায়ত জ্ঞানে সামষ্টিক কাজ হিসেবে দেখা হয়। আর লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসাই লোকায়ত চিকিৎসাবিদ্যার প্রধান সূত্র। চাকমা তালিক, মারমা বৈদ্য, মান্দি খামাল কি মণিপুরী মেইবাদের চিকিৎসাবিদ্যা কী গ্রামীণ কবিরাজি সবই লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসাকে গুরুত্ব দেয়। অসুস্থ ও আক্রান্তের ইতিহাস, তার পরিবেশ-প্রতিবেশ, সমাজে নানামুখী সম্পর্ক এসব জানতে চায়। আর এই লোকায়ত চিকিৎসায় গুরুত্ব পায় প্রাকৃতিক জিনসম্পদ। একতরফাভাবে ‘ভেষজ বা টোটকা চিকিৎসা’ নামে এই লোকায়তবিজ্ঞানকে দাবিয়ে রাখলেও সহ¯্র বছর ধরে এই বিজ্ঞানই দুনিয়াকে দিয়ে চলেছে বেঁচে থাকবার সব অবিস্মরণীয় পথ্য ও যোগান। এই করোনাকালেও অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানী, চিকিৎসক কী গণমাধ্যম পরামর্শ দিচ্ছে গরম পানি, ভিটামিন সি, আদা, রসুন, কাঁচা হলুদ, নিম, কালোজিরা, আমিষ, গোলমরিচ, লবঙ্গে গ্রহণের মতো নানা লোকবিধির। এইসব কার আবিষ্কার? কার উদ্ভাবন? করোনার মতো লক্ষণে এইসব পথ্য ও সুরক্ষাবিধি তো লোকায়ত চিকিৎসাবিদ্যার নিজস্ব ফসল। তার মানে এই দাঁড়ায় শ্রেণিপ্রশ্নে নি¤œবর্গের হলেও লোকায়ত জ্ঞান অভিজ্ঞতাই এই করোনাকালে বিশ্বের লাখো মানুষের সহায় হচ্ছে। কিন্তু সংকট সামালে নি¤œবর্গের এই জ্ঞানভাষ্য ও বিধির অবিস্মরণীয় অবদানকে আমরা তো এখনো মর্যাদা দিতে শিখিনি। অনৈতিহাসিক করে রাখি এর ভূমিকা।

লোকায়ত লকডাউন
আদিবাসীরা কেন নিজেদের মতো লকডাউন চালু করতে পেরেছে? নতুন অসুখ আর মহামারী থেকে বাঁচতে আদিবাসী সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরেই লকডাউন, আইসোলেশন, সঙ্গনিরোধের চল আছে বলেই এটি এসব সমাজে এতোটা সহজ হচ্ছে। বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় ¤্রােদের ভেতর অসুখ ও মহামারী থেকে বাঁচার জন্য গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার যে কৃত্য পালিত হতো একসময় তার নাম আং ডুব। আশেপাশে কোথায় মহামারীর বিস্তার হলে গ্রামের লোকেরা একত্র হয়ে কিছুদিন গ্রামকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রস্তুতি নিতেন। জংগলের ঝিরি-ছড়া থেকে ভোর বেলা ¯œান সেরে তুলে আনা হতো ছোট ছোট পাথর। এইসব পাথরে মহামারী তাড়ানোর মন্ত্র লেখা হতো সুইয়ের আঁচড়ে। গ্রামের সবাই কাপাস তুলোর সূতা দিয়ে গ্রামের চারধারে বাঁধন দিতেন। গ্রামের সকল প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়া হতো। প্রতিটি প্রবেশপথে মাটির তলায় গুঁজে রাখা হতো মন্ত্রপুত পাথর। চলতি করোনাকালেও ¤্রােরা আংডুব কৃত্যের মাধ্যমে পূয়াভং বা গ্রাম লকডাউন করেছেন। রাঙামাটি ও বান্দরবানের পাংখোয়া আদিবাসীরাও একসময় বড়ধরণের অসুখ ও মহামারী সামাল দিতে নানা কৃত্য পালন করতো একসময়। ঝিরি থেকে ছোট পাথর সংগ্রহ করা হয় এবং এই পাথরে মহামারীর বিরুদ্ধে মন্ত্র আঁকা হয়। পাংখোয়া ভাষায় এই কৃত্যকে ‘লুংতেরঙেট ইন তোয়ালে রিত’ বলে। এরপর শুরু হয় গ্রামবন্ধের কাজ। পাংখোয়া ভাষায় একে খোয়া খার বলে। খোয়াখারের সময় ঘরে বহিরাগত কেউ গ্রামে ঢুকতে পারে না, গ্রাম থেকে কেউ বাইরেও যেতে পারে না। এমনকি গ্রামের ভেতরেও যারা থাকে তাদেরও ঘরে প্রবেশের পূর্বে ঘরের সামনে জ্বালানো আগুনে হাত-পা সেঁকে ঘরে ঢুকতে হয়। পাংখোয়া ভাষায় এই রীতিকে বলে ‘মেই রাকান’। লকডাউনের মান্দি কৃত্যের নাম দেনমারাংআ, লেঙাম ভাষায় খাং চোনং, চাকমারা বলে আদাম বন গারানা, খাসিরা বলে খাং খারদেপ সোনং, কোচ-বর্মণদের ভেতর গেরামপূজার মাধ্যমে ও ত্রিপুরাদের ভেতরকার পূজার মাধ্যমে গ্রাম লকডাউন করা হয়। কেবল আদিবাসী সমাজ নয়, প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কি সংহিতাতে মহামারী নির্মূলে লকডাউন ও সঙ্গনিরোধের কথা উল্লেখ আছে। তার মানে কোনো রোগ বিস্তার ও সংক্রমণ রোধে এই লকডাউন ‘বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা’ প্রদত্ত কোনো নতুন ধারণা নয়। এটি জনসমাজে প্রচলিত মহামারী সামালের এক লোকায়ত কায়দা, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা যার নাম দিয়েছি ‘লকডাউন’।

চেনা পথ্য, জানাশোনা চিকিৎসক
কেবল বহুজাতিক ভ্যাকসিন কী করোনা সামাল দিতে পারে? সমাজের খাদ্যাভাস, স্বাস্থ্যবিধি, জীবনযাপনের ধরণ এবং এমনকি মানুষের জিনগত বৈচিত্র্যও এখানে প্রভাব রাখে। মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, তাইওয়ান, মিয়ানমার কিন্তু বেশ যুতসইভাবেই সামাল দিচ্ছে এই সংকট। উত্তর-পূর্ব ভারতেও এর ব্যাপক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েনি। ঠিক যেমন এখনো বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সংক্রমণ কম। কিংবা শ্রীলংকা কিভাবে সামাল দিচ্ছে এই করোনাকাল? উল্লিখিত দেশগুলোর খাদ্যসংস্কৃতি ও স্বাস্থ্যবিধির অনেকখানিই এখনো প্রকৃতিনির্ভর এবং ভেষজপন্থী। মানুষের রোগপ্রতিরোধক্ষমতা তৈরিতে এই প্রকৃতিবিজ্ঞানের নিশ্চিত ভূমিকা আছে। লোকায়ত স্বাস্থ্যবিধির মূলে আছে পথ্যের সাথে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। কিন্তু আজকের চিকিৎসা দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করা বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানির শিশি বোতল কী প্যাকেটে কী থাকে আমরা ক’জন তার খোঁজ রাখি? এমনকি গ্রামীণ সমাজের এক একজন অভিজ্ঞ লোকায়ত চিকিৎসক চারধারের মানুষের বেড়ে ওঠার সাথে জড়িত। রোগ নির্ণয় ও লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসায় তাই রোগীর ইতিহাস ও নির্ঘন্ট নানাভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা তৈরি হয়। কিছু অভিজ্ঞ আদিবাসী লোকায়ত চিকিৎসকের সাথে আলাপ হলে তারা জানান, করোনার লক্ষণের মতো রোগের পথ্য ও বিধি কিছুটা তাদের জানা। মহামারীর মতো এক নির্দয় পরিস্থিতি সামালে আজকে এমন লোকায়ত চিকিৎসাবিদ্যাকেও সামগ্রিক কৌশলে যুক্ত করা জরুরি। এমনকি আর্য়ুবেদ, হোমিওপ্যাথি, ইউনানী ও গ্রামীণ কবিরাজিকে। হয়তো করোনা মোকাবেলার এভাবেই রাষ্ট্রীয় বহুত্ববাদী চিকিৎসার রূপ তৈরি হতে পারে।

অসুখের দর্শন
আদিবাসীসহ গ্রামীণ নি¤œবর্গ মনে করে মানুষের অসুখ হলো প্রকৃতির কোনো যন্ত্রণার নির্দেশনা। বৃক্ষের বর্ষবলয়ে যেমন খরা কী প্লাবণের দাগ থাকে, মানুষের শরীর কী স্মৃতিতেও অসুখের দাগ রয়ে যায়। অসুখ ও মহামারী সম্পর্কিত লোকায়ত কৃত্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব কৃত্যে উচ্চারিত প্রার্থনায় কেবল মানুষ নয় চারধারের প্রাণের সুস্থতার প্রার্থনা জানানো হয়। বাঁশের মড়ক যেমন ইঁদুর-বন্যা কী শকুনের অনুপস্থিতি যেমন গরুর অ্যানথ্রাক্স। নির্দয়ভাবে কাটা হলে গাছ, সমূলে বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বিস্তার ঘটলে একসময় মানুষও রেহাই পাবে না। আদিবাসীরা অনেক আগে থেকেই এই হুঁশিয়ারি দুনিয়াকে জানিয়ে আসছিলো। নয়াউদারবাদী দুনিয়া কথা শোনেনি। কেবল করোনা নয়, প্রমাণিত হয়েছে গরিষ্ঠভাগ মহামারীর পেছনে আছে বন্যপ্রাণীর দশাসই বাজার। করোনাকালে আমাদের অসুখের দর্শনটা বদলানো দরকার। প্রকৃতির শরীরেই মানুষের অসুখের চিহ্ন আছে। সেই লক্ষণ বোঝার মতো দক্ষতা ও সাহস তৈরি হোক প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাবিদ্যায়।

ভোগ নয়, সুরক্ষাই জীবনের নীতি
করোনাকালে দিনাজপুরের সাঁওতাল সমাজ বাহা পরবে পবিত্র জাহেরথানে সম্মিলিত প্রার্থনা করে শালফুল গ্রহণ করেছে। প্রকৃতির কোনো স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ কী রঙ নি¤œবর্গের সমাজে গ্রহণের আগে নতজানু হতে হয়। প্রার্থনা করতে হয়। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে সকল লোকায়ত কৃত্য। কোন মাসে, কোন ঋতুতে কি কি বিধিনিষেধ তা এখন কয়জন জানে? আর মানেইবা কতজন? নয়াউদারবাদী জীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখন সারাবছর বাজারমুখী শস্যফসল মেলে। কোনোকিছু দেখে বোঝার উপায় নেই এটা কোন ঋতু। লোকায়ত জীবনের বীক্ষা ভোগ নয়, সুরক্ষা। প্রাণ ও প্রকৃতির ভেতর সম্পর্ককে বোঝার জন্য একটা জীবনের সাথে আরেকটা জীবনের যোগাযোগ। লোকায়ত জ্ঞান আর প্রকৃতির বিজ্ঞানের এই সুরক্ষানীতিই আজ আমাদের করোনার নিদান থেকে আবারো তরতাজা করে তুলতে পারে। যদি আমরা ভোগকে বাতিল করে নতজানু হই সুরক্ষামিছিলে।

happy wheels 2

Comments