সাম্প্রতিক পোস্ট

করোনা মহামারীর পুরুষতান্ত্রিক রূপ

ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ

করোনা মহামারীতে হয়তো কিছুটা থেমেছে ধর্ষণ। বা হয়তো করোনার আড়ালে খবর গুলো সামনে আসছে না। কিন্তু করোনাকালে থামছে না নারীর প্রতি প্রশ্নহীন সহিংসতা। যুদ্ধ থেমেছে, বন্যপ্রাণীর বাজার বন্ধ হয়েছে, হানাহানি রুদ্ধ হয়েছে, কারখানাগুলোও থমকে আছে। গ্রাম থেকে দেশ-দুনিয়া লকডাউনে। কেবল লকডাউন হয়নি পুরুষতান্ত্রিক মন। করোনাকালে থামছে না প্রবল পুরুষতান্ত্রিকতা। মহামারীকালে পুরুষতন্ত্র আরো যেন সহিংস হয়ে ওঠে। কলেরা, গুটিবসন্ত, কালাজ্বর কি প্লেগের সময়ের নির্দয় স্মৃতিগুলোও তাই বলে। ঘর-সংসার থেকে রোগের প্রকোপ সব সামলালেও নারীর সংক্রমণ কী মৃত্যু যেন ছিল তখন দুধভাত। অভাব ছড়িয়ে পড়লে কত নারীদের বন্ধক কি বিক্রি করা হয়েছিল সেইসময়। মহামারী, দুর্ভিক্ষ কী দুর্যোগে নারীর ধকল বেশি। নারীকেই টানতে হয় শংকা ও সামালের দু:সহ সব চাপ। কিন্তু মহামারীকালে তারপরও নারী যেন খারিজ খাতার প্রথম নাম। নারীর প্রতি ঐতিহাসিক পুরুষতান্ত্রিকতা টিকে থাকে মহামারী থেকে উৎসব সকল কালেই, সকল পরিসরেই। কারণ এই বৈষম্যের গণিত জেগে আছে আমাদের মগজে। সুদিন কী দুর্দিন হোক এই মগজ কী আর লকডাউন হয়? এই মনস্তত্ত্ব কী দুম করে বদলে যায়? আর তাই এই করোনাকালেও করোনাসন্দেহে নারীকে ফেলে রাখা হয় জংগলে, রাস্তায়, ঘরে ফেরা নিষিদ্ধ করে পরিবার কী সমাজ। পরিবার ও সমাজ কী রাষ্ট্র করোনা থেকে বাঁচতে প্রথমেই যাকে খারিজ করতে চায় সে এই নারীরাই। যেমন জোর করে গার্মেন্টসের মেয়েদের ঘর থেকে টেনে রাস্তায় আনা হয়েছিল। পরিবার, সমাজ কী রাষ্ট্র তো এই বিপদ থেকে তাদের ঘরে সঙ্গনিরোধ করতে পারেনি। কারণ গার্মেন্টস শ্রমিকদের গরিষ্ঠভাগই নারী। নারীর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কী করোনা সংক্রমণ নিয়ে পুরুষতন্ত্রের মগজ একেবারেই প্রস্তুত নয়। করোনা সন্দেহে ঘটে যাওয়া নারীর প্রতি কিছু সহিংসতাকে টেনে চলতি আলাপখানি মহামারীর পুরুষতান্ত্রিক রূপটিকে বুঝতে চায়। মহামারী সামাল দিতে হলে এই প্রবল পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রথমেই লকডাউন করতে হবে। যখন চারধারে লকডাউন, কিন্তু নারী তো থেমে নেই। ঘরসংসারের সব সামলে বীজ বুনছেন নারী, কুড়িয়ে আনছেন শাকলতা, তুলছেন চাপাতা, করছেন পারিবারিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা। এমনকি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা ও সেবার পুরোটাই তো করছেন পরিবারের নারীরা। হিসাব করলে মহামারী সামালে নারীর অবদানের পরিসংখ্যান নি:সন্দেহে এগিয়ে থাকবে। কিন্তু তারপরও এই দু:সময়ে পরিবার, সমাজ কী রাষ্ট্র নারীকে খারিজ করতে চায় সবার আগে। মহামারী সামালে নারীর সামগ্রিক অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েই পুরুষতান্ত্রিক মগজের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। আর এই করোনা সংকট এক সামষ্টিক সুযোগও তৈরি করে দিল।

চুলকাটা মা
ঢাকার সাভারে লকডাউনের আগে কাজ হারানো এক পরিবারের মা খরচ কুলাতে না পেরে নিজের চুল বিক্রি করেছিলেন। যদিও সামাজিক মাধ্যমে এটি ভাইরাল হয়েছিল ভুলভাবে যে, করোনা সংকটে সন্তানের দুধ কিনতে চুল বিক্রি করেছেন মা। কিন্তু ১৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখে করোনা সন্দেহে এক ময়ের চুল কেটে তাকে ফেলে যায় সন্তানেরা এই সাভারেই। চুলকাটা এই মা বসেছিলেন সাভারের হেমায়েতপুর জয়নাবাড়ি এলাকায় । তার সন্তানেরা তার চুল কেটে হাতে কিছু খাবার ধরিয়ে এখানে তাকে ফেলে গেছে। পরে প্রশাসন তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এই নারীরও দায়িত্ব নিয়েছেন। এই যে নারীর চুল বিক্রি বা চুল কেটে দেয়া এটি একেবারেই এক পুরুষতান্ত্রিক আচরণ। নারীর চুল, শরীর, সৌন্দর্য কী মন নিয়ন্ত্রণ করা পুরুষতন্ত্র। চুল কেটে সন্তানেরা কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? তাদের মা ‘পাগল’। কেন পরিবার অসুস্থ এই নারীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিল না? করোনাতো পরিবারের অন্য পুরুষদেরও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তাহলে এই নারীকেই কেন প্রথম বাতিল করলো পরিবার?

গ্রামছাড়া মা
ঢাকা থেকে ফিরেছে বলে সংকটের এই সময়ে এক শ্রমিক পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রবীণ মা। করোনার কোনো প্রাথমিক লক্ষণও তার নেই। ঐ পরিবারটিও নেই। কিন্তু গ্রামে রটলো এই প্রবীণ নারী ঢাকা ফেরত পরিবার থেকে করোনা ছড়াবেন গ্রামে। এরপর পরিবার কী গ্রামের সমাজ কেউ ঘরে তুলছে না তাকে। ১২ এপ্রিল ২০২০ গ্রাম ছাড়া করা হয়েছে এই প্রবীণ মাকে। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামের এই নারীকে স্কুল ঘরের বারান্দায় পেয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ খাদ্য সহযোগিতা করেছেন।

জংগলে মা
১৩ এপ্রিল ২০২০। গাজীপুরের সখীপুরের শালবন থেকে এক প্রবীণ নারীর কান্নার আওয়াজ শুনে স্থানীয়রা। পরে উপজেলা প্রশাসন তাকে উদ্ধার করে কুর্মীটোলা হাসপাতালে ভর্তি করায়। জংগলে পড়ে থাকা মায়ের কাছ থেকে জানা যায়, করোনার সন্দেহে তার সন্তানেরা তাকে জংগলে রেখে গেছে। তারা বলে গেছে, মা তুমি এই বনে এক রাত থাকো, কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব। রামায়ণে যেমন সীতাকেই করতে হয় বনবাস কী অগ্নিপরীক্ষা। এই করোনাকালেও নারীর হয় নির্দয় বনবাস।

মগজ লকডাউনের এইতো সময়!
করোনাকালে পুরুষের প্রতি কী অবহেলা করছে পরিবার কী সমাজ? পুরুষকে কী খারিজ করছে প্রথমে পরিবার কী সমাজ থেকে? করছে না। কারণ পুরুষের চোখেই এই মহামারী সামালের ফর্দ নিয়ে এগুচ্ছি আমরা। করোনাসন্দেহে কয়েকজন পুরুষের সাথেও এমন ঘটেছে। কিন্তু তারা পুরুষ বলে নয়, তাদের শ্রেণিপরিচয় ও মানসিক সুস্থতাকে সেখানে আন্দাজ করেছে সমাজ। ২৮ মার্চ ২০২০ তারিখে পণ্যবাহী ট্রাকে ঢাকা থকে রংপুর ফিরছিলেন এক শ্রমিক পুরুষ। পথে তার শ্বাসকষ্ট ও কাশি শুরু হলে করোনা সন্দেহে তাকে জোর করে ট্রাক থেকে ফেলে দেয়া হয় বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান বাসস্ট্যান্ডে। ১৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখে পাবনার বেড়া উপজেলার যমুনা নদীর চরে চরসাফুল্লা গ্রামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন প্রবীণ পুরুষকে উদ্ধার করে আইসোলেশনে নেয় প্রশাসন। প্রশাসন জানায়, করোনা সন্দেহে তাকে হয়তো ফেলে রেখে গেছে পরিবারের লোকজন। নিতান্তই দিনমজুর আর মানসিক ভারসাম্যহীন প্রবীণ বলেই সমাজ এমন অবহেলা দেখিয়েছে। পুরুষ হয়েও এই অবহেলিতদের বর্গে লিঙ্গ কী শ্রেণিদেমাগ নেই। আমরা বিদ্যমান এইসব সামাজিক দেনদরবার থেকে কতোটা বাইরে আসতে পারছি এই করোনা সংকটে? আমাদের মগজ ভরপুর নিদারুণ শ্রেণিবৈষম্য আর নানামুখী বিভেদ। আমরা তাই করোনা মোকাবেলায় নারীর সামগ্রিক সুরক্ষা ও শক্তি নিয়ে ভাবছি না। করোনা মোকাবেলার কায়দাকে শ্রেণি ও বর্গভেদে সকল নারীর ময়দান থেকেই বিশ্লেষণ জরুরি। এই সংকট মোকাবেলায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুই পেশাগত শ্রেণি মূল যুদ্ধটি করছেন। চিকিৎসক, নার্স আর কৃষক। আাদের স্বাস্থ্য ও খাদ্যযোদ্ধা। এই যোদ্ধাদের গরিষ্ঠভাগই নারী। করোনাকালে প্রতিটি হাসপাতালে নির্ঘুম নার্স ও কৃষিতে নির্ঘুম নারীর ভূমিকা কী আমরা বেমালুম ইতিহাসহীন করে দিব? তাহলে কী এই সংকট সামাল হবে? মহামারীর পুরুষতান্ত্রিক কোনো রূপ থাকেনা, এটি তৈরি করে সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্যের গণিত। আর এর সূত্র ও সংখ্যাগুলো আমাদেরই মগজে। এখনই সময় এসব বৈষম্য উপড়ে ফেলার। সকল লিঙ্গ, বর্গ আর শ্রেণির সম্মিলিত সক্রিয়তাই সামাল দিতে পারে করোনা মহামারী। আসুন কাউকে কোথায় বাতিল বা খারিজ না করে নিজের বৈষম্যের মগজটা আগে বদলাই। পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব লকডাউন করি।

happy wheels 2

Comments