করোনায় গোলাপ বাগান এখন জঙ্গল বাগান

মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম: ফুলকে ভালবাসে না এমন মানুষ ও প্রাণী জগতে বিরল। তাইতো ফুলকে কেন্দ্র করেই আমাদের হাজারো কাব্য, গীত ও কত কত সৃষ্টি। আজকে সেই ফুলকে জীবিকার মাধ্যম করেছে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে সেই ফুল বিক্রি করতে পারছে না চাষীরা আর তাই গোলাপ বাগান পরিণত হচ্ছে জঙ্গলবাগানে।

মানিকগঞ্জ সিংগাইর অঞ্চলের শেষ প্রান্তের এক গ্রাম ফোর্ডনগর। গ্রামটি ধল্লা ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে একেবারে সাভার ধামরাই বর্ডারে। গ্রামটিকে এখন আর মানুষ ফোর্ডনগর হিসেবে নয় গোলাপনগর নামেই বেশি চিনে। এই গ্রামের অধিকাংশ কৃষি পরিবার অন্যান্য ফসল কম চাষ করে গোলাপ চাষের দিকে ঝুকছে। অনেক ক্ষেতমজুর ও তরুনরা তাদের বেকারত্ব ঘুচাতে জমি বন্ধক নিয়ে বাহারি রঙের ফুল চাষ করে স্বাবলম্ভী হয়েছেন। এমন অসংখ্য ঘটনা আমরা লোকমুখে শুনেছিলাম। কিন্তু এ করোনা কালে এই ফুল চাষিরা ভুগছে নানান সংকটে। সেই তথ্য অনুযায়ী এই মানুষদের মুখ থেকেই আমরা শুনার চেষ্টা করেছি তাদের জীবন ও সংগ্রামের কথকতা।

ফোর্ডনগরের ক্ষেতমজুর মো. জাহাঙ্গীর আলম (৩৪)। ফুলচাষী হিসেবে বেশ সফল বলেই সকলে তাকে সম্মান করে। তিনি বলছিলেন, আমি ৬ বছরের জন্য আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে ৫ বিঘা জমি কটে নিয়েছি। ফুল চাষে প্রচুর খরচ ও পরিশ্রম। আমি, আমার মা ও স্ত্রী-কণ্যাসহ সারাদিন গাঁধার মত পরিশ্রম করছি। তিনি বলেন, এ পরিশ্রম যে সেই পরিশ্রম নয়, প্রতিনিয়তই ফুল গাছ ছেটে দিতে হয়। নিয়মিত সার-বিষ,পানি ও ছেটে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করতে হয়। তবে সুবিধা হলো একবার জমিতে গাছ হয়ে উঠলে ২০ বছরের মধ্যে আর রোপন করতে হবে না। জাহাঙ্গীর বলছিলেন প্রতিবছর নানান কাজে লক্ষাধিক টাক খরচ করেও প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকা রোজগার করতাম। ফুলেরও প্রচুর চাহিদা ছিলো। ঢাকা, গাজীপুর ও মুন্সিগঞ্জ ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকেও ফুলের চাহিদা আসত। আমরা তো পানির দামে বেপারিদের কাছে বিক্রি করি,তারপর তারা আবার আড়তে নিয়ে বিক্রি করে, আবার খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে বিক্রি করে। কতগুলো হাত বদল হয়ে ২টাকার গোলাপ ১০-২০ টাকাও বিক্রি হয়।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতি তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। এভাবে বসে বসে আর কতদিন থাকা যায় বলে তারা আফসোস করছিলেন। তার বক্তব্য আমরা রিলিফ চাই না, চাই কাজ। আমাদের এই কাজের উপর ভিত্তি করে অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকা। আমরা ফুল বিক্রি করতে না পারলে না পারবো সার, তেলের দাম দিতে আর না পারবো মজুরি দিতে। আর তাদের জীবনই বা চলবে কি করে।
আরেক কৃষাণী সালেহা বেগম (৫৫) বলেন, বছরে কয়টি দিনেই তো ফুল বেশি বিক্রি হয় কিন্তু এবার সর্বনাশ হয়ে গেলো। শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয়। মনের দু:খে এখন আর জমিতে যাই না। ফুলগুলো পচে জমি নষ্ট হয়ে গেছে। সর্বনাইশা মহামারী করোনায় গোলাপবাগান এখন জঙ্গলবাগানে পরিনত হয়েছে।

তিনি বলেন, টিভিতে শুনি সরকার রিলিফ দেয় কিন্তু আমরা এখনো কিছুই পাই নাই। এই বছর চাষবাস করতে গিয়ে আরো ঋণে জড়িয়ে পরেছি। নাতিদের লেখাপড়া হচ্ছে না।
একই পরিস্থিতির শিকার খানপাড়া চর ফোর্ডনগর কৃষক মো.খোরশেদ আলম (৫৫) সহ অনেকেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিংগাইর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার খাতুন বলেন, এ পরিস্থিতিতে সিংগাইর ফোর্ডনগরের ফুলচাষীদের জন্য বিনা সুদে স্বাল্পমেয়াদী ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। যে সকল চাষীরা ঋণগ্রস্থ আছেন পাওনাদার এনজিও ও ব্যংক কর্মকর্তারা যেন তাদের উপর চাপ তৈরি না করেন এবং কেউ চাপ সৃষ্টি করলে অবশ্যই উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করার অনুরোধ করেন।
পুরো বিশ্ব আজ ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দাড়িয়ে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির সরূপ আজ নতুন করে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আজকে সিংগাইরের ফুলচাষীদের সাথে ইতালীর শ্রমজীবী মানুষের তফাত দেখা যাচ্ছেনা। তাই দরকার একটি এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা যেখানে সকল মানুষ মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে। করোনাকে জয় করে আমরা নতুন পৃথিবীকে বরণ করে নেবো।

happy wheels 2

Comments