আতংক ও অনিশ্চয়তার সাথে অহর্নিশ বসবাস

ইন্টারনেটের ফ্রি সোর্স থেকে নেয়া

নিরালা পুঞ্জি শ্রীমঙ্গল থেকে সিলভানুস লামিন:
এক
সরকার প্রচারিত একটি স্লোগান মনে হয় এরকম ‘আতংক নয়; সচেতনতায় করোনা থেকে মুক্তি মেলে’। আমিও সচেতন। আমার পরিবারের সদস্যরাও সচেতন। আমার আত্মীয়স্বজন কিংবা গ্রামের মানুষ সবাই সচেতন হওয়ার চেষ্টা করেন। আমি বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করি। কোন জিনিস স্পর্শ করলে কিংবা কারও কাছ থেকে কোনকিছু নিলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করি। কখনও কখনও যখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার না পাই কাপড় কাচার সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত পরিষ্কার করি। আমি অযথা হাত দিয়ে মুখ, নাক, কান কিংবা চোখ স্পর্শ না করার চেষ্টা করি। খাবারের বেলায় ভিটামিন সি কিংবা জিঙ্ক উপাদান আছে এমন জাতীয় খাদ্য খাওয়ার চেষ্টা করি। যাতে আমার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া কারও সাথে কথা বললে ৩ ফুট দূরত্বে অবস্থান করি। আমার সন্তান, স্ত্রী, মা এবং ভাইবোনসহ সবাইকেই এই পরামর্শ দিই। বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করি বিধায় সময় পেলেই টিভি দেখার চেষ্টা করি। পুষ্টিবিদ ও অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ শোনার চেষ্টা করি। তাঁরা যা বলেন বা পরামর্শ দেন সেটা মানার যেমন চেষ্টা করি ঠিক তেমনি সবাইকে জানার দায়িত্ব নিই। যতটুকু সচেনতন হওয়ার কথা সাধ্যমতো ততটুকু সচেনতন থাকার চেষ্টা করি। এতকিছুর পরও মাথায় সবসময় একটা আতংক কাজ করে। যতবার নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করি এই বলে যে, ‘বাংলাদেশের এখনও এক শতাংশ মানুষও করোনায় আক্রান্ত হয়নি। যারা আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে সুস্থ হয়েছেন’ তারপরও আমার মন কিছুতেই আশ^স্ত হচ্ছে না। একা বসলেই কিংবা ঘুমাতে গেলেই মস্তিষ্কের মধ্যে করোনা ভাইরাস আতংক বারবার হানা দেয়।

দুই
যখনই চিন্তা করি করোনা ভাইরাস নিয়ে তখনই নিজেকে প্রশ্ন করি ‘আজ আমি কি সারাদিন হাত না ধুয়ে মুখ, নাক, চোখ বা কান স্পর্শ করেছি কি না। অবচেতন মনে কি বাইরে থেকে আসা জিনিস স্পর্শ করার পর মুখে বা নাকে হাত দিয়েছি কি না! আবার নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার স্ত্রী, সন্তানেরা কি কারও সংস্পর্শে এসে হাত না ধুয়ে কি চোখ, মুখ ও কান স্পর্শ করেছে কি না? হাত না ধুয়ে তারা কি খেতে বসেছে কি না? কারণ আমরা অবচেতন মনে অনেককিছুই করি যেটা অনেকসময় স্মরণ করতে পারি না। এছাড়া আমরা অনেকে বসলে কিংবা খেললে হাত দিয়ে মুখ, চোখ কিংবা না স্পর্শ করার অভ্যাস রয়েছে। আমি নিজেও একা বসলে এবং কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে আমার একটা হাত অবচেতন মনেই মুখ স্পর্শ করে। দীর্ঘদিনের অভ্যাস কিন্তু রাতারাতি বদলানো খুব কঠিন। অন্যদিকে আমরা অনেকেই বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধ কিনি অন্যের কাছ থেকে কিংবা কোনকিছু বিক্রি করলে টাকা গ্রহণ করি অন্যের হাত থেকে। লেনদেন ছাড়া থাকাও কিন্তু কষ্টসাধ্য কাজ। এই লেনদেন করার সময় আমরা অসাবধানতাবশত যদি হাত পরিষ্কার না করি কিংবা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব না মানি তাহলে এ রোগটি আমাদেরকে আক্রান্ত করতে পারে। আমার পরিবারে যদি কোন একজন সদস্য আক্রান্ত হয় তাহলে পুরো পরিবারের সদস্যরাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে, আমাদের গ্রামে লকডাউন শিথিল করার পর থেকে মানুষের ভেতওে উঠাবাসও বেড়ে গেছে। বাইরে থেকেও মানুষ গ্রামে প্রবেশ করেছেন এবং গ্রাম থেকে অনেকে শহরে গেছেন। তাদের সাথে নিত্যদিনেই আমাদের কথাবার্তা হয়। গ্রামের যে চিরাচরিত পরিবেশ সেটি আবার তার রূপ পেয়েছে। সবার সাথে গল্পগুজব, আদান প্রদান ও সহযোগিতা আবার আগের মতোই হয়েছে। শিশুরা উঠানে, মাঠে খেলছে! এর মধ্যে সরকার ৩১ মে থেকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি অফিস আদালত, ট্রেন, লঞ্চ ও গণপরিবহণ সীমিত পরিসরে চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চিন্তা করি, সৃষ্টিকর্তা না করুক, এর মধ্যে সংক্রমণের হার কি আরও বেড়ে যাবে না তো? এসব ভাবলে অজানা একটা আতংক বারবার মাথায় ভর করছে। আতংক যেন আমাকে আর পিছু ছাড়ছেই না। এত আতংকে কখনও ছিলাম না কোনদিন। এ যেন আতংকের সাথে অর্হনিশ বসবাস।

তিন
অন্যের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় এত সাবধানতা অবলম্বন করে, স্বাস্থ্যবিধি মনে কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পর মনের ভেতরে বারবার খটখটানি হয়। চিন্তা করি, করোনা রোগীদের সেবা করে এমন অনেক ডাক্তারও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁরা তো অনেক সচেতন ছিলেন। তারা পিপিইসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষা মেনেই এসব রোগীদের চিকিৎসা করেছেন। তাহলে তাঁরা কীভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন? অবচেতন মনে তাঁরাও কি সেসময় হাত দিয়ে মুখ, নাক কিংবা চোখ স্পর্শ করেছেন? নাকি তাঁরা যে সুরক্ষা নিয়েছেন সেটি করোনা থেকে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত ছিলো না। পত্রিকান্তরে জেনেছি, কিছু সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মকর্তারাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছেন করোনায়। তাঁরাও কি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা গ্রহণ করেননি? নাকি গ্রহণ করার পরও তারাও অবচেতন মনে বা অভ্যাসবশত হাত দিয়ে মুখ, নাক কিংবা চোখ স্পর্শ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা ভাইরাসটি মানবদেহে মুখ, নাক, কান ও চোখ দিয়ে প্রবেশ করে। তাই তো সরকারসহ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাদানকারী সংস্থাগুলোও বারবার হাত ধোয়ার কথা বলেছেন এবং সেটি ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে অত্যন্ত ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত। আমি চিন্তা করি, আমি তো মাস্ক ও হাত গ্লাবস ছাড়া আর কোন সুরক্ষায় গ্রহণ করিনি, আমার পরিবারের সদস্যরা কিংবা আমার আত্মীয়স্বজনেরাও আমার মতো শুধু মাস্ক ও হাত গ্লাবস ব্যবহার করেন বাইরে গেলে কিংবা কারও সাথে লেনদেন করার সময়ে! তাহলে কোন করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসলে আমরা কি সুরক্ষিত হবো? আমাদের উপজেলা এবং ইউনিয়নে বর্তমানে করোনা রোগী রয়েছেন। এর মধ্যে দু’একজন মারাও গেছেন। পণ্য বেচাকেনা কিংবা কেনাকাটা করার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের উপজেলা ও ইউনিয়নের ব্যবসায়ীদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করি। তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করার সময় আমরা টাকা গ্রহণ করি। যদিও টাকা গ্রহণ করার পর আমরা সবাই-ই হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করি, গ্রহণ করা টাকাগুলোতে ওষুধ ছিটাই। আবার পণ্য কেনার সময়ও একই সুরক্ষা মেনে চলি। তারপরও এখনও আতংকিত হই, লেনদেনের সময় আমরা কি সঠিক সুরক্ষা মেনে করেছি কি না? নাকি সেকেন্ডের ভগ্নাংশের অবচেতন মনে আমরা ভুলে যাই! যদি সত্যিই ভুলে যাই তাহলে কি হবে? এসব ভাবলেই কেমন জানি আতংকিত হয়। আতংক যেন আমাকে আর ছাড়তেই চায় না।

চার
আমি ঢাকায় চাকুরি করি প্রায় ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে। করোনার কারণে প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে নিজ গ্রামে অবস্থান করি। ঢাকায় আমার সহকর্মীরা যখন অনলাইনে নানাধরনের সভা, আলোচনা কিংবা অন্যান্য কাজ করেন তখন আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করার কারণে কোনকিছুতেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারিনি। নিজের ভেতরে একটা অপরাধবোধ সবসময় কাজ করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকার কারণে ইন্টারনেট কিংবা কম্পিটার সুবিধা না থাকায় আমি কোনকিছুতেই অবদান রাখতে পারিনি। এতে করে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে একরকম অনিশ্চয়তায় ভুগি। বাস্তবতা ও সিদ্ধান্তের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সবসময় কাজ করে। কখনও কখনও মনে হয় ঝুঁকি নিয়ে হলেও ঢাকায় ফিরি, সহকর্মীদের সাথে আমি অনলাইনে যুক্ত হয়ে কিছু কিছু বিষয়ে অবদান রাখি। কিন্তু আমার পরিবার, আমাকে একা ঢাকা যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। আমার সন্তানেরাও আমাকে একা যেতে মানা করে। তাদের দিকে চেয়েও আমিও অনেকবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, আমার উচিত ঢাকায় ফিরে যাওয়া। তবে পরিবার সদস্যদের কেউ কেউ আমাকে আমার চাকুরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরামর্শ দেন। তাদের সাথে আমার কোন বিষয়ে মতের মিল খুজে পাইনা? চাকুরি থেকে ইস্তফা দিলে আমার ভবিষ্যত কি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে না? চাকুরি না করলে কীভাবে থাকবো, চলবো? কিংবা যে জীবনযাত্রায় আমি অভ্যস্ত সেই জীবনযাত্রা পরিবর্তন করা কি আমার জন্য সম্ভব? এ নিয়ে তাদের ভেতরে কোন ভাবান্তর নেই। তাদের যুক্তি, ‘আগে জীবন তারপর চাকুরি বা কাজ’। অন্যদিকে, যখনই আমার সিদ্ধান্তে আমি অনড় থাকার চেষ্টা করি এই বলে যে, ‘আমি ঢাকায় ফিরে আমার সহকর্মীরা যেভাবে কাজ করছেন আমিও সেভাবেই কাজ করবো’ তখন আমার সহধর্মীনি আমার ঢাকার সঙ্গী হতে চায়। কোনভাবেই সে আমাকে একা যেতে দেবে না! অথচ করোনা পরিস্থিতির কারণে গ্রামে ফিরেছি তার (সহধর্মীনি) কথা ভেবেই। কারণ তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটু কম এবং তার কিছু দীর্ঘদেয়াদী রোগ আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যাদের দীর্ঘমেয়াদী কোন রোগ আছে এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটু কম তাদেরকে বেশি সাবধান থাকবে হবে। তাহলে তাকেও সাবধান হতে হয়। কিন্তু আমাকে একা যেতে দেবেনা; আমার সঙ্গী হবেই হবে! জীবনে এত অনিশ্চয়তা এত সংকোচবোধ কিংবা এত সংশয় আর কখনো ছিলাম না! কোনদিক থেকেই ইতিবাচক কোনকিছু খুঁজে পাচ্ছিনা। মাথার ভেতরে সারাক্ষণ একটা চিন্তাই কাজ করে যে, ‘কীভাবে সিদ্ধান্ত নেব? কী করবো?’ তাই সবকিছু মিলে আমি কেমন যেন একটা ‘মানসিক আইসোলশনে’ আছি। কোনকিছুতেই হিসেব মিলছে না আমার। এমনিতেই আতংক বসবাস শুরু করেছে আমার মনের গহীনে। এর মধ্যে জীবন ও জীবিকা সংক্রান্ত এই অনিশ্চয়তাও আমার মনের জানালায় উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আজ আমি তাই অহর্নিশ আতংক ও অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করেই জীবন নির্বাহ করি।

happy wheels 2

Comments