সাম্প্রতিক পোস্ট

কৃষিতে বালাইনাশকের অযৌক্তিক ব্যবহার

ঢাকা থেকে এবিএম তৌহিদুল আলম

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’র কৃষিতথ্য সার্ভিসেস (এআইএস) প্রকাশিত তথ্যানুসারে বাংলাদেশে মোট ফসলী জমির প্রায় ৭৬% জমিতে ধান চাষ করা হয় যার প্রায় ৭০% ভাগই আধুনিক জাতের। স্থানীয় জাতের তুলনায় এই সব জাতে ভাল ফলনের জন্য বেশি পরিমাণে সার ও সেচ দিতে হয়। তাই স্থানীয় জাতের তুলনায় এসব জাতে পোকামাকড়ের আক্রমণও বেশি। বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে ধান ফসলের মোট ১৭৫ প্রজাতির ক্ষতিকর পোকা শনাক্ত করা হয় (করিম ১৯৮৫)। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে ২৬৬ প্রজাতির পোকাকে ধানের জন্য ক্ষতিকর পোকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (ইসলাম ও অন্যান্য ২০০৩)। তবে সব পোকাই সব মৌসুমে বা সব জায়গার ধানের ক্ষতি করে না। ধানের জন্য ক্ষতিকর প্রধান পোকা (মাজরা, পামরি, বাদামী গাছফড়িং) তিনটি। তবে মোটামুটি ২০ প্রজাতির পোকা ধান ফসলের সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিকর পোকা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ পোকাগুলো বোরো মৌসুমে ১৩%, আউশ মৌসুমে ২৪% আর আমন মৌসুমে ১৮% ধানের ক্ষতি করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর তথ্যমতে, প্রতিবছর ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণে সবজি ফসলের শতকরা ২৫ ভাগ এবং ফলের ক্ষেত্রে শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষতি হয়ে থাকে। এছাড়াও পোকা-মাকড় ফসলের গুণগতমান ও বাজারমূল্য কমিয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবতনজনিত বিরূপ প্রভাব পাশাপাশি এ দেশে উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধি ও বিচরনের জন্য খুবই সহায়ক।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় ৩০ লাখ প্রজাতির পোকামাকড় আছে যার মধ্যে মাত্র ১০ লাখ প্রজাতির পরিচয় জানা গেছে। এদের মধ্যে অসংখ্য উপকারী পোকা ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে, ডিম নষ্ট করে, আহত করে, প্রজনন ব্যাহত করে, কীড়া নষ্ট করে, পরাগায়ন করে কৃষির উপকার করছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেশের শস্যক্ষেতে ৬০৭ ধরনের পোকা পরিলক্ষিত হয় বলে জানা যায়। এর মধ্যে মাত্র ২৩২টি (৩৮.২২ শতাংশ) কীটপতঙ্গ ও পোকা ফসলের জন্য ক্ষতিকর। বাকি ৩৭৫ টি (৬১.৭৭ শতাংশ) কীটপতঙ্গ বা পোকা ফসলের জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে উপকারী। এর মধ্যে ১৮৩টি (৩০.১৫ শতাংশ) পোকা সরাসরি ফসলের জন্য উপকারী। আর ১৯২টি (৩১.৬৩ শতাংশ) পোকা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে বা পরজীবী ও পরভোজী হিসেবে পরোক্ষ ভাবে ফসলের উপকার করে থাকে।

বাংলাদেশে বালাইনাশকের আমদানি ও ব্যবহার
দেশে বালাইনাশক বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৭৭টি কোম্পানির ২৩৫ ধরনের বালাইনাশক আমদানি হয়। আমদানিনির্ভর বালাইনাশকগুলো দেশে ফরমুলেশন করে বা সরাসরি আমদানি করে দেশে বাজারজাত করা হয়। মূলত বিদেশ থেকে বালাইনাশক আমদানি করা হয় গ্রানুলার, লিকুইড ও পাউডার আকারে। দেশে সাধারণত পাঁচ ধরনের বালাইনাশক যেমন কীটপতঙ্গ দমনের জন্য ইনসেকটিসাইড, ছত্রাক জাতীয় রোগ দমনের জন্য ফাঙ্গিসাইড, আগাছা দমনের জন্য হার্বিসাইড, মাইট দমনের জন্য মাইটিসাইড ও ইদুর জাতীয় প্রাণী দমনের জন্য রোডেনটিসাইড ব্যবহার করা হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিসিপিএ এর তথ্য মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত আট বছরে দেশে মোট ৪ লাখ ২২ হাজার ৬৬৬ টন বালাইনাশক আমদানি করা হয়েছে যার মধ্যে ইনসেকটিসাইডের পরিমাণ ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৬ টন যা মোট ব্যবহৃত বালাইনাশকের প্রায় ৩৯ শতাংশ। এর ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৩১ দশমিক ৫৭ টন গ্রানুলার ইনসেকটিসাইড, ৩৬ হাজার ৯০৯ দশমিক ৫০ টন লিকুইড ইনসেকটিসাইড ও ৯ হাজার ৪৯৫ দশমিক ৩৫ টন পাউডার ইনসেকটিসাইড। উল্লিখিত সময়ে দেশে ৪৯ হাজার ৭১১ দশমিক ৬৭ টন ফাঙ্গিসাইড জেনারেল ও ১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪২ দশমিক ৪০ টন ফাঙ্গিসাইড সালফার আমদানি করা হয়েছে। একই সময়ে ৩৮ হাজার ৭১১ দশমিক ৭০ টন হার্বিসাইড, ৮২৫ দশমিক ৮৪ টন মাইটিসাইড ও ৬৩৮ দশমিক ১ টন রোডেনটিসাইড আমদানি করা হয়েছে। আর এই হিসাবের বাইরে প্রতি বছর চোরাইপথে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসছে প্রচুর কীটনাশক। দেশের আমদানিকৃত কীটনাশক মূলত চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর ও জার্মানি থেকে আনা হয়।

অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়েরর অধীন পেস্টিসাইড টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (কীটনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি)’র তথ্য মতে, দেশে বিগত ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ এই তিন বছরে পূববর্তী বছরগুলির তুলনায় কীটনাশকের ব্যবহার ও আমদানি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম ছিল। ২০১২ সালে দেশে ৬২ হাজার ৮৪৫ টন কীটনাশক, ২০১৩ সালে হয় ৪১ হাজার ৬০৭ টন ও ২০১৪ সালে ৩৯ হাজার ২৫৩ টন কীটনাশক আমদানি হয়েছিল। তবে একই সময়ে এটাও দেখা গেছে যে, আগে কীটনাশক ব্যবহৃত হতো না এমন অনেক ফল ও সবজিতে নতুন করে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়েছে। দেশে কীটনাশকের ব্যবহারের পরিমাণ কমলেও এখন যে পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে তা পরিবেশসহ জনস্বাস্থ্য, উপকারী কীটপতঙ্গ ধ্বংস ও জমির উর্বরতা শক্তি নষ্টের জন্য যথেষ্ট। দেশে বায়োপেস্টিসাইড বাজারজাতকরণ শুরু হওয়ায় পর কীটনাশকের আমদানি ও ব্যবহার কমছে বলে মনে করা হয়।

কৃষকের অভিযোগ: কমেছে বালাইনাশকের কার্যকারিতা
সাম্প্রতিক সময়ে কৃষকদের কাছ থেকে একটি অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায় যে বালাইনাশক প্রয়োগ করেও ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা যাচ্ছে না। যার ফলে ফলন কমছে অন্যদিকে ফসল উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বালাইনাশক কাজ না করার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হলো বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার। অধিকাংশ কৃষকরাই অতিরিক্ত মাত্রায় ও নিজের ইচ্ছেমত বালাইনাশক ব্যবহার করেন। বিধি মোতাবেক সাধারণত সাত থেকে দশ দিন অন্তর বালাইনাশক প্রয়োগ করার কথা থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে এক থেকে দুইদিন অন্তর পর্যন্ত বালাইনাশক প্রয়োগ করা হয়। আবার একই বালাইনাশক মাসের পর মাস ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত একই জমিতে ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় যথাযথ বালাইনাশক ব্যবহার না করে কিংবা একাধিক বিষ একত্রে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও পোকামাকড় দমনে একক ভাবে শুধুমাত্র বালাইনাশকের উপর নির্ভরতার কারণেও পোকামাকড়সমূহ ধীরে ধীরে বালাইনাশকের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে উঠে। তখন বালাইনাশক প্রয়োগ করেও আর পোকামাকড় দমন করা যায় না। আবার সঠিক বালাইনাশক নির্বাচনে সমস্যাও এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। কৃষকদের কীটনাশক নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন দেশের বিভিন্ন বিক্রেতা কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধিরা। তারা অনেকসময় ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য কৃষকদের অধিক মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগের জন্য প্রলুদ্ধ করেন এবং ভুল বালাইনাশক দিয়ে থাকেন। আবার কখনো কখনো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের পর্যাপ্ত ও যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় তারাও কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন না।

বালাইনাশক ছাড়া চাষাবাদ কতটুকু সম্ভব?
ফসলের ক্ষেতে সব পোকাই ক্ষতিকর নয়। ঢালাওভাবে বালাইনাশক ছিটানোর ফলে উপকারী পোকাও মারা যায়। এতে করে কৃষককে আরো বেশি বালাইনাশক ব্যবহার করতে হছে এবং বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। আবার শস্যের নিবিড়তা আনতে গিয়ে ফসলে রোগবালাই ও পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ক্ষেতে অতিমাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ করছেন কৃষক। সার্বিকভাবে বাড়ছে ফসলে বালাইনাশকের ব্যবহার। তবে কারো কারো মতে চাষাবাদ এবং পোকা দমনে ভুল পদ্ধতি প্রয়োগের কারণেই বালাইনাশক ব্যবহারের ব্যাপকতা বাড়ছে। জমির বালাইগুলোকে ধ্বংস না করে বরং প্রতিরোধ করেও ফসল চাষাবাদ করা সম্ভব। ফসলের জমিতে মূলত দুই ধরনের পোকার আক্রমণ হয়। শস্যের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এক ধরনের পোকা ফসলে আক্রমণ করে। আরেক ধরনের পোকা শস্যের কাণ্ড, ডগা কিংবা দানা থেকে রস খাওয়ার জন্য ক্ষেতে আক্রমণ করে। গন্ধে আকৃষ্ট পোকার জন্য ক্ষেতের আইলে বা আশপাশে নানা ধরনের বিকট গন্ধযুক্ত ছোট গাছপালা, বিশেষ করে ছোট ছোট বুনো তামাক লাগানো যেতে পারে। অন্যদিকে যেসব পোকা রস খেতে আসে, সেগুলি রোধের জন্য তিতা ফল বা পাতার রস ফসলে স্প্রে করা যেতে পারে। পাশাপাশি একই এলাকায় একই ধরনের শস্যের আবাদ করলে বিশেষ পোকার আক্রমণ বাড়তে পারে। তাই শস্য আবাদে বৈচিত্র্যতা এবং শস্যপর্যায় অবলম্বন করা গেলে পোকার আক্রমণ কমে। অন্যদিকে পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষার জন্য যে প্রাকৃতিক উপায় রয়েছে বালাইনাশকের বিকল্প হিসাবে সেগুলোকে কৃষকদের মধ্যে প্রচার-প্রসার করা দরকার।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বা আইপিএম বালাইনাশকহীন শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশে সবজি জাতীয় ফসলের প্রধান ইনসেক্ট পেস্ট দমনের জন্য উৎপাদন প্যাকেজ প্রণয়ন করা হয়েছে। আইপিএম ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র একটি দমন ব্যবস্থার উপর নির্ভর না করে কতগুলো কার্যকরী দমন ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি প্যাকেজ প্রণয়ন করা হয় যেমন রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার, যান্ত্রিক দমন, জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার, জৈববালাইনাশক ব্যবহার, উপকারী পোকামাকড়ের ব্যবহার, সেক্্র ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার, পার্চিংসহ পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পদ্ধতি প্রভৃতি। আইপিএম ধারণায় ক্ষতিকর পোকামাকড় বিনাশ না করে বরং ব্যবস্থাপনা করা হয়। আইপিএম ব্যবস্থাপনায় রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার কমে। এ ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। একইসাথে এটাও বিবেচনা করা হয় যে, ক্ষতিকর পোকামাকড় প্রকৃতিতে ছিল, আছে এবং থাকবে কিন্তু ক্ষতি করতে পারবে না, কেননা নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় উপস্থিত থাকবে। অর্থাৎ ইকোনোমিক ইনজুরি লেবেলের নিচে থাকবে। এখানে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধকে বেশি গুরত্ব দেয়া হয়। পোকামাকড় এর আক্রমণে ফসলের সামান্য কিছু ক্ষতি হতে পারে তবে তাতে উদ্বিগ্নœ হওয়ার কোন কারণ নেই। আর সর্বশেষ দমন ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক প্রয়োগ বিবেচনা করা হয়। তবে তা আবশ্যই নির্দিষ্ট মাত্রায়, নির্দিষ্ট পন্থায় এবং নির্দিষ্ট বিরতিতে। এক কথায় আইপিএম হলো ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনের জন্য পরিবেশবান্ধব, সুসংহত এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি।

রাসায়নিক কৃষির দুষ্ট চক্রে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ
বর্তমানে আমাদের দেশের কৃষকরা পোকামাকড় দমনের জন্য প্রায় সম্পূর্ণভাবে রাসায়নিক বালাইনাশকের উপর নির্ভরশীল। আগে শুধুমাত্র দানাশস্যে বালাইনাশকের ব্যবহার হলেও এখন প্রায় সব ধরনের সবজি ও অন্যান্য শস্যেও বেশুমার ব্যবহার হচ্ছে। যার ফলে গত একদশকে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩২৮ ভাগ। যদিও বালাইনাশকের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যবহার হয় ধান ফসলে তথাপিও একক জমিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহৃত হয় শাক-সবজি উৎপাদনে। এইচিত্র শুধু বাংলাদেশের একার নয়। বিশ্বব্যাপী ফসলে বালাইনাশকের ব্যবহার ধরণ ও পরিমাণ গত ৬০ বছরে ব্যাপক হারে বেড়েছে।

ফসলের রোগ পোকা দমনে মূলত তিন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার হয়। প্রথমত সিস্টেমিক ধরনের বালাইনাশক যা শাকসব্জির গায়ে বা জমির মাটি যেখানেই প্রয়োগ করা হোক না কেন তা গাছের কান্ড পাতা ইত্যাদি দ্বারা গৃহীত হয়ে ভাস্কুলার বান্ডলে কাজ করে। এরা গাছের খাদ্যরসের সাথে বাহিত হয়ে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে গাছকে বিষাক্ত করে দেয়। পোকা এ গাছের রস খেলে বিষক্রিয়ায় মারা যায়। দ্বিতীয় ধরনের বালাইনাশক হলো স্পর্শ বা কন্টাক বিষ। এই ধরনের বালাইনাশকের সংস্পর্শে পোকা আসলে পোকা মারা যায়। পোকার পাখা, উদর প্রভৃতির কাইটিন নির্মিত ত্বক ভেদ করে দেহের ভিতরে গিয়ে বিষক্রিয়া শুরু করে এবং কোষের রাসায়নিক কাঠামো ভেঙে দেয়। কামড়ায় ও চোষণ করে এসব পোকার জন্য এই ধরনের বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। অপর ধরনের কীটনাশক হলো পাকস্থলী বিষ যা তখনই কার্যকরী হয় যখন তা কীটপতঙ্গের খাবারের সাথে পাকস্থলীতে পৌঁছায়। পরে রক্তের সাথে মিশে গিয়ে বিষক্রিয়া তৈরি করে। গাছের যে অংশ কীট খাবার হিসাবে গ্রহণ করে সেখানে এই কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়।

এটা ঠিক কীটদমন করে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে তবে বালাইনাশক ফসলের মধ্য দিয়ে মানুষের শরীরে ও এসেছে। পাশাপাশি বেড়েছে কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশেই কীটনাশকের সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক ব্যবহার হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী কীটনাশকের (ইনসেকটিসাইড) গড় ব্যবহার মাত্র ২২ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে এ হার ৩৯ শতাংশ যা বৈশ্বিক ব্যবহার মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর’র হিসাব মতে দেশে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার ৫৪২ কেজি বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়। বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় ৫৫ জন মানুষ কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত— হয় এবং প্রায় ৭ লাখ লাখ ৫০ হাজার মানুষ দীর্ঘমেয়াদী দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান মতে বিশ্বে প্রতিবছর বালাইনাশক প্রয়োগের সময় দূর্ঘটনায় ২০ হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করেন ও ১০ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। আর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯-২০০০ সালের হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, সারা বিশ্বে ব্যবহৃত ৩০ লাখ মেট্রিক টন কীটনাশকের ১৮ টি মানুষের দেহে ক্যান্সারের বিস্তার ঘটানোর সঙ্গে যুক্ত।

শস্যফসলে কীটনাশকের ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাতœক আকার ধারণ করেছে। উৎপাদিত ফসলে কীটনাশকের ক্ষতিকর উপাদান (অবশেষ) থেকে যাওয়ায় তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীটনাশকের ‘অবশেষ’ ফসলে কত দিন থাকে তা না জেনেই কৃষকেরা এর ব্যবহার করছেন ও বাজারজাত করছেন। বালাইনাশক বিপণনকারী কিছু কোম্পানি রাসায়নিকের প্রয়োগবিধি অনুসরণ না করে ব্যবহার বাড়াতে প্রান্তিক চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছে। তাই বাজারজাতকৃত ঢেরস, বরবটি, লালশাকসহ কিছু সবজিতে কীটনাশকের অবশেষ থেকেই যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) তাদের গবেষণায় বাজারে বিক্রি হওয়া ৯১ শতাংশ কাঁচামরিচে অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের ‘অবশেষ’ পেয়েছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। একই প্রতিষ্ঠান বিগত ২০১৪ সালে কাঁচামরিচ পরীক্ষা করে তাতেও কীটনাশকের অবশেষ পেয়েছে। এভাবে মানুষের খাবারে কীটনাশক চলে আসায় মানুষের লিভার আক্রান্ত হওয়াসহ স্নায়ুরোগ, রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, গর্ভপাত, বিকলাঙ্গ সন্তান প্রসব বাড়ছে। বালাইনাশক ব্যবহারে মহিলাদের স্তন ক্যান্সার বিশ্বে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বালাইনাশকের প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গকে দূর্বল করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে। এমনকি মায়ের দুধের মধ্যেও এর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থা ফসল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। বালাইনাশকের এমন অযৌক্তিক ব্যবহার প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অপরদিকে বালাইনাশক জমিতে দেওয়ার ফলে শস্যের উপকারী পোকা-মাকড় ও মাটিতে বসবাসকারী ব্যাঙ, কেঁচো, সাপ ও মাটির ভেতরের ক্ষুদ্র অণুজীবও প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এছাড়া বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে নদী-নালা ও অন্যান্য জলাধারে প্রাকৃতিক মাছের বিলুপ্তি ঘটছে। বিষাক্ত হচ্ছে বাতাস, মাটি ও পানি। তাই কীটনাশক আমদানি, বিতরণ ও ব্যবহারে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন।

বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সরকারী উদ্যোগ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশে বালাইনাশকের ব্যবহার কমাতে বিগত কয়েক দশক ধরেই দাতা সংস্থার অর্থায়নে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ১৯৮১ সালে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) আন্তঃদেশীয় কর্মসূচির মাধ্যমে ধানে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫ সময়কালের সরকার ও দাতাদের সহায়তায় পরিচালিত হয় সমন্বিত বালাই দমন কার্যক্রম (ইন্ট্রিগ্রেটেড পেস্ট কন্ট্রোল)। কৃষককে এ বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে ২০০৬ সাল থেকে নেওয়া হয় এগ্রিকালচার এক্সটেনশন কম্পোনেন্ট (এইসি) প্রকল্প। ১৯৯৬ সালে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১৭২ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু হয়েছে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প। দেশের ৮ টি বিভাগের ৬১ জেলায় ৩১৭ টি উপজেলায় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিষমুক্ত ও কীটনাশকমুক্ত শাক-সবজি ও ফল চাষাবাদ পদ্ধতি কৃষকের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে পরিতাপের বিষয়, বালাইনাশকের ব্যবহার কমানোয় এ ধরনের প্রকল্প সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (আইপিএম) ধারণাকে খুব বেশি প্রসারিত করা সম্ভব হয়নি। দেশে এখন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ কৃষক রয়েছেন যার সিংহভাগই এ কার্যক্রমের আওতায় আসতে পারেননি। ধারণা করা হয়, দেশের মাত্র ২০ শতাংশ কৃষকের কাছে এইসব প্রকল্পের কার্যক্রমের মাধ্যমে বালাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। আবার কৃষিকাজে শ্রমিক সংকটের কারণেও বালাইনাশকের কিছুটা ব্যবহার বাড়ছে। সরকার কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন নিয়ম-নীতির আওতায় এনেও বালাইনাশক আমদানিকে নিরুৎসাহিত করছে। সরকার কৃষিতে বায়োপেস্টিসাইডসের ব্যবহার বাড়ানোরও চেষ্টা করছে। তবে সঠিক প্রচার প্রচার-প্রচারনার অভাবে বায়োপেস্টিসাইডসের প্রতি কৃষকের আগ্রহ এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি। একই ভাবে সরকারকেই সারা বিশ্বে যে জৈবকৃষির প্রচলন শুরু হয়েছে সেটি কার্যকরভাবে দেশে চালুর উদ্যোগ নিতে হবে।

বালাইনাশক আমদানি, বাণিজ্যিক ভাবে প্রস্তুতকরণ, নতুনভাবে ফর্মুলেশন, বিক্রয়, বিতরণও ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও তদারকি করার জন্য আমাদের দেশে প্রথম বালাইনাশক অধ্যাদেশ, ১৯৭১ (চবংঃরপরফবং ঙৎফরহধহপব, ১৯৭১, ঙৎফ. ঘড়. ওও ড়ভ ১৯৭১) প্রণীত হয়। এরপর বালাইনাশক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০০৭, বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) আইন, ২০১৮ ও সর্বশেষ বালাইনাশক বিধিমালা ২০১৯ (খসড়া) প্রণয়ন করা হয়। বালাইনাশক (সংশোধিত) আইন,২০০৯ (ঞযব চবংঃরপরফবং (অসবহফসবহঃ) অপঃ, ২০০৯) এর অধীনে কোনো ব্যক্তি নিম্নমানের কীটনাশক বিক্রি, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শণ, বিজ্ঞাপন প্রচার করে, তবে প্রথম বার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় বার করলে ৭৫ হাজার টাকা, দুই বারের বেশি করলে ১ লাখ ও আর অর্থ পরিশোধে অপারগ হলে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত শাস্তি প্রদানের বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইনের ব্যবহার খুবই সীমিত। নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যবসায়ীরা যেমন যথেচ্ছভাবে বালাইনাশক বিক্রি করছেন আবার বিষের মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েও আমদানিকারকরা আমদানির অনুমতি পাচ্ছেন। সেই বালাইনাশক ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কৃষকেরা কিনছেন। ফলে পরিমাণের দিক থেকে কোনো কোনো বছর বালাইনাশকের আমদানি কমলেও তাতে বিষের মাত্রা কেমন তার কোনো পরীক্ষাও হচ্ছে না। দোকানে গিয়ে যে কেউ যেকেনো পরিমাণে বালাইনাশক কিনতে পারেন। ফসলে কৃষক কি পরিমাণে কীটনাশক কিভাবে প্রয়োগ করছেন তা তদারকির ক্ষেত্রেও ঘাটতি রয়েছে। মানা হচ্ছে না ফসলে বালাইনাশক ব্যবহারের পর নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে ফসলসংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের কাজ। বালাইনাশকের বোতল বা প্যাকেটে বাধ্যতামূলকভাবে সাবধানতাও লিখা থাকছে না। দেশে বালাইনাশকের বিষের মাত্রা নির্ধারণ করতে ২০১৫ সালে একটি আধুনিক পরীক্ষাগার তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হলেও কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে তারও কোনো সময়সীমা নেই। সরকারকেই মাঠপর্যায়ে বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্র¿ণে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। সময় এসেছে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বালাইনাশক বিক্রয় নিয়ন্ত্র¿ণ করার। সর্বোপরি মাঠপর্যায়ে কৃষক কীভাবে বালাইনাশক ব্যবহার করছেন তা পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের। আর সেটি নিশ্চিত হলেই কমতে পারে দেশে বালাইনাশকের অযৌক্তিক ব্যবহার।

happy wheels 2

Comments