প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর করোনাকালীন পুষ্টির আঁধার বসতবাড়ি বাগান

সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান

সুস্থ জাতি মানেই উন্নত দেশ। দেশের জাতীয় উন্নয়নে পুষ্টি সমৃদ্ধ, সুস্থ, সবল ও সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাখে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বাংলাদেশের বিশাল এই জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ জনগোষ্ঠী জীবিকায়নের প্রধান পেশা কৃষি। তাই দেশের জাতীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৃষির উপরই নির্ভরশীল। এই কৃষি পেশার সাথে জড়িত তাদের বেশির ভাগ কৃষকই প্রান্তিক ও ভূমিহীন। বড় কৃষক কৃষি কাজ থেকে সরে যাওয়ায় অন্যের জমি লিজ, বর্গা নিয়ে মাঠে যে ফসল চাষ ফলান তাতে যা  আয় হয় জমির লিজবাবদ, সার, কীটনাশক, শ্রমিক খরচ দিয়ে লাভের মুখ দেখা কৃষকের সংখ্যা খুবই কম। সকল দেনা পাওনা মিটিয়ে নিজ হাতে ফলানো ফসলের স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত হন। অন্যের জন্য নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির যোগান দিতে গিয়ে নিজেরাই ভুগেন নানা ধরনের অপুষ্টিজনিত রোগে। ভুলেই যান পুষ্টি ও নিরাপদ খাবার পাওয়া তাদেরও অধিকার। তাই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ও ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির অধিকার নিশ্চিত করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ের জন্য যেটা খুবই প্রয়োজন।

সারা দুনিয়ার মানুষ আজ করোনা নামক এক অদৃশ্য ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করছেন নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য। এখনো করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পড়া এবং সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়া এগুলোই করোনা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাথমিক উপায় । তাছাড়া কোন প্রতিষেধক না থাকায় বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থায় করোনার সংক্রমণ মোকাবিলা করা খুবই কঠিন কাজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সচেনতার পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তারা করোনায় আক্রান্ত হলেও ভাইরাসটি প্রতিরোধ সক্ষম। তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেশি পরিমাণে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।

সরকারের পাশাপাশি বেসরকারির উন্নয়ন সংস্থা বারসিকও মানিকগঞ্জ কর্মএলাকার গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বসতবাড়ি বাগানে সবজি চাষ, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ ও করোনাকালে স্বাস্থ্য বিধি নিয়ে সচেতনতামূলক পরামর্শ প্রদান করে আসছে নিয়মিত। বারসিক’র পরামর্শে ঘরবন্দী সময়ে সিংগাইর উপজেলার বলধারা বায়রা ইউনিয়নের রেনু মন্ডল, লিপিকা মন্ডল, সেলিনা বেগম, রমেলা বেগম, জয়তুন বেগম, কমলা বেগম, ভানু বিবি, মনোয়ারা বেগম, লাইলী বেগম, রুপশী বেগম, শহীতন বেগমের  মত দেড় শতাধিক কৃষাণি করোনাকালে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি পুরণে নিজেদেরকে যুক্ত রেখেছেন বাড়ির উঠানে পালানি জমিতে নানান জাতের সবজি চাষে। বসতবাড়ির আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা জমিগুলোতে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলেছেন বসতবাড়ি বাগান। চাষ করছেন,পুই শাক, লালশাক, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, চিচিংগা, ঝিংগা, বেগুন, কাকরোল, বরবটি, ধুন্দল, ওস্তেসহ নানা ধরনের শাকসবজি। কৃষাণীরা নিরাপদ উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সার ও বিষ পরিহার করে ব্যবহার করছেন জৈব সার, বাসী ছাই। তাছাড়া অনেকের বাড়িতেই রয়েছে কাকজি লেবু, এলাচি লেবু, কলম্ব লেবু, আম, কাঁঠাল, পেঁপে, জাম, কলা, বেল লিচুসহ নানা জাতের ফল, যা করোনাকালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছে। বসতবাড়িতে উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূল পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি উদ্বৃত্তগুলো বাজারে বিক্রি করে তাঁরা আয় করছেন বাড়তি টাকাও। এ ধরনের কাজে বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরাও সহযোগিতা করছে। এর ফলে তাদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই কৃষির সাথে পরিচয় ঘটছে। নিয়মিত শাকসবজি আর ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠছে।

এ প্রসঙ্গে কাস্তা বারোওয়ারি কৃষক কৃষানি সংগঠনের সহ-সভাপতি লিপিকা মন্ডল বলেন, ‘বসতবাড়িতে সবজি চাষ করে নিজেরা খাই এবং বাজারে বিক্রি করি। যদি এত সবজি বাজার থেকে ক্রয় করা হতো তাহলে করোনার তিন মাসে ৩০০০ টাকা লাগতো। করোনার সময় যে পুষ্টির দরকার তা আমরা বাড়ি থেকেই পাই। তাই বাড়ির আশেপাশে সবজি চাষ করে খুব সহজেই আমরা পুষ্টির অভাব পূরণ করতে পারি ‘ অন্যদিকে বাংগালা নব-কৃষক কৃষাণী সংগঠনের সদস্য রেনু মন্ডল বলেন, ‘করোনা থেকে সুস্থ্ থাকতে হলে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, ফলমুল, দুধ ও ডিম খাওয়া দরকার। তাই আমাদের যেন বাজার থেকে এগুলো কিনতে না হয় সেজন্য বাড়িতেই, হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু পালন করছি। গ্রামের প্রতি বাড়ি যেন একেকটি সবজি বাগান। গরুর গোবর থেকে শুরু করে সবজির খোসা এসব গর্তে ফেলা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর সবজি বাগানে ব্যবহার করা হয় এসব সার। তাই সবজিগুলো হয় নিরাপদ ও বিষ মুক্ত। এভাবেই স্বল্প পরিসরে সবজি বাগান করে আমরা আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছি।’

happy wheels 2