ঘুড়ি যুবকদের করোনাকালীন বিনোদন

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়:
করোনা সংকটের এই সময়ে মানুষকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। অনেকেই বাড়িতে বসে খোশগল্পে মশগুল, কেউ আবার এই অবরুদ্ধ সময়টিকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি উপার্জন করছেন। তেমনি এক ব্যতিক্রমী মানুষ লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের গদাইকান্দি গ্রামের মো. শান্তু মিয়া। তিনি বিভিন্ন ধরণের ঘুড়ি তৈরি করে বিক্রি করছেন। এবং এ থেকে যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে সংসারের চাহিদা পূরণ করছেন।
মো. শান্তু মিয়া একজন চা দোকানদার। লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে তাঁর চায়ের দোকান আছে। করোনায় সকল কিছু বন্ধ হয়ে যায় এবং বাজারে প্রশাসনের নজরদারি থাকায় তিনি দোকান গুটিয়ে বাড়িতে চলে যান। এরপর থেকে তাঁর বাড়িতেই সময় কাটছে। কৃষিজমি না থাকায় ফসল চাষ করতে পারেননি। তাছাড়া বয়সে প্রবীণ হওয়ায় কোনো পরিশ্রমের কাজ করতে পারেননা বলে অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবেও কেউ নেয়নি।
করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে গদাইকান্দি গ্রামের যুবকরা এই গ্রামটিকে সম্পূর্ণরুপে লকডাউন অবস্থায় রেখেছে। অন্য গ্রাম থেকে এই গ্রামে প্রবেশ করা বা নিজেরা অন্য গ্রামে যাওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট কঠোরতা অবলম্বন করে। গ্রামের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী যুবক মিলে প্রতিদিন একবার করে পুরো গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঘুরে ঘুরে সকলের খোঁজ খবর রাখে। এছাড়া গ্রামের যে সকল পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় থেকে কাজ করেন তাদেরকেও এই গ্রামে আসতে নিষেধ করে। এই অবস্থায় প্রবীণ শান্তু মিয়ার কিছুই করার ছিলনা। যে ব্যক্তি সারা দিনের অধিকাংশ সময় বাজারে কাটাতেন তাঁর কাছে বাড়িতে থাকা অবস্থায় দিনগুলো অসহ্য মনে হচ্ছিল।
আমাদের দেশে করোনা রোগী সনাক্ত হওয়ার কয়েকদিন পরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর একটি ছেলে কলেজে পড়ে। কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে বাড়িতে চলে আসে। পড়াশোনার চাপ নেই, আবার বাড়ি থেকে বের হওয়া বা সমবয়সীদের সাথে গল্প করা এসবের কিছুই করতে পারছেনা। নিজের ছেলের মতো অন্যরাও এই সময়ে বাড়িতে থেকে অনেকেই অকারণে রাগারাগি করা, পরিবারের সদস্যদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি শুরু করে। তাঁর চোখের সামনে এসব হতে দেখে তিনি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে।
এই চিন্তা থেকেই তিনি এদের জন্য কিছু করবেন বলে ঠিক করেন। তিনি ভেবে দেখলেন ছোটবেলায় ধান কাটা শেষ হলে তাঁরা ধানের জমিতে গিয়ে ঘুড়ি উড়াতেন। সময় কোন দিক দিয়ে চলে যেতো বুঝতেই পারতেন না। এখনকার সময়ে ছেলেরা রাস্তায় বসে গল্প করে নয়তো বা মোবাইলে ছবি দেখে। তিনি এসমস্ত ছেলেদের বিনোদনের জন্য বাড়িতে বসে ঘুড়ি বানানো শুরু করলেন। প্রথমে তিনি তাঁর নিজের ছেলেকে একটি বানিয়ে দিলেন। দেখলেন ছেলে ঘুড়ি নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত। ছেলের সমবয়সী যারা আছে তারাও ছেলের পেছন পেছন ঘুড়ির সাথে দৌড়াচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি নিজ খরচে আরো কয়েকটি ঘুড়ি তৈরি করে অন্যদের দিলেন। এই ছেলেদের দেখে গ্রামের অন্যান্য ছেলেরা দলে দলে শান্তু মিয়ার বাড়িতে আসতে শুরু করলো।
তিনিও একটি কাজ পেয়ে গেলেন। একটি, দুটি করে ঘুড়ি তৈরি করে দিতে গিয়ে দেখলেন প্রায় সমস্ত গ্রামের ছেলেরা এখন ঘুড়ি উড়ানোয় ব্যস্ত। এই গ্রামের ছেলেদের দেখে এখন অন্যান্য গ্রাম থেকেও অনেকে এসে ঘুড়ি তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
ঘুড়ি তৈরি করতে যেহেতু বিভিন্ন উপকরণ যেমন কাগজ, সূতা, আঠা, বাঁশ ইত্যাদির প্রয়োজন হয় তাই তিনি যারা ঘুড়ি তৈরি করতে আসে তাদের বলেন তারা যেন এগুলো নিয়ে আসে। তবেই তিনি ঘুড়ি বানাতে পারবেন। কারণ তিনি দরিদ্র, এছাড়া এখন দোকানও বন্ধ। এগুলো যোগাড় করতে যে পরিমাণ খরচের দরকার, সে পরিমাণ টাকা এখন তাঁর কাছে নেই।
তাই এখন যারা ঘুড়ি তৈরি করতে আসে তারা কাগজ বা সূতা এগুলো নিয়ে আসে। আঠা, বাঁশ এগুলো তিনিই যোগাড় করেন। প্রথম অবস্থায় অনেককেই বিনামূল্যে ঘুড়ি তৈরি করে দিয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি টাকার বিনিময়ে ঘুড়ি তৈরি করছেন। শান্তু মিয়ার অভাবের সংসার। তাছাড়া প্রতিদিন ৩/৪জন করে ঘুড়ি নিতে আসে। এ সময়ে যদি ঘুড়ির বিনিময়ে কিছু উপার্জন করা যায় তবে সংসারের চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবেন।
প্রতিদিন তিনি ২/৩টি করে ঘুড়ি তৈরি করতে পারেন। কয়েক ধরণের ঘুড়ি তিনি তৈরি করেন। এগুলোর মূল্যও নির্ধারণ করেছেন ধরণ অনুযায়ী। সাধারণ ডিজাইনের প্রতিটি ঘুড়ি তিনি ২০০ টাকার বিনিময়ে তৈরি করেন। এছাড়া অনেকে নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী ডিজাইন বলে দিলে তিনি তা তৈরি করে দিতে পারেন।
শান্তু মিয়ার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে একদিকে যেমন তাঁর সংসার চলছে অন্যদিকে আমাদের সমাজের যুবক, কিশোর এরাও বিপথে না গিয়ে ভিন্ন ধরণের বিনোদনে নিজেদের যুক্ত করতে পেরেছে। আবার এই ঘুড়ি উড়ানো আমাদের বাংলার একটি ঐতিহ্য। করোনায় যখন অনেকে দিশেহারা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তখন শান্তু মিয়ার ঘুড়ি আমাদের চিরায়ত বাংলাকে ফিরিয়ে এনেছে।

happy wheels 2