সাম্প্রতিক পোস্ট

করোনাকালের কৃষিবাজেট: আটখানা প্রস্তাব

ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ:
‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পথপরিক্রমা’ শিরোনামে ইতোমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে করোনাকালের জাতীয় বাজেট। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা যা গতবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৮.৪৬ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৩.২৪ শতাংশ বেশি। ৫টি মন্ত্রণালয় মিলে এ বছরের বাজেটে কৃষিখাতের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, যা গতবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা বেশি। গতবছরের চেয়ে এবছরের মূল বাজেট ৮.৫৬ শতাংশ বাড়লেও কৃষিখাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৫.৭৪ শতাংশ। করোনাকাল প্রমাণ করে চলেছে কারখানাভিত্তিক উৎপাদন নয়, কৃষির মতো প্রাকৃতিকসম্পদনির্ভর গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থাই কেবল মহামারীর মতো সংকট সামাল দিতে পারে। ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ থেকে রাষ্ট্র আমরা সবাই এটিতো আবারো আন্দাজ করতে পারছি যে, আমাদের ভোগবিলাসিতা আর একতরফা উৎপাদন-উন্নয়নের জন্যই প্রাণ-প্রকৃতির নিদারুণ দুর্দশা তৈরি হয়েছে। দিকে দিকে এখন পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার বার্তা ঘোষিত হচ্ছে। এমনকি আমাদের জনপ্রতিনিধি কী গণমাধ্যমের অনেকেই প্রাণ-প্রকৃতিকে আগলে বিনিয়োগ আর উন্নয়নের জরুরিত্ব তুলে ধরছেন। তাহলে করোনাকালের বাজেটে নিশ্চিতভাবেই এর প্রতিফলন থাকা জরুরি। বিশেষকরে কৃষিখাতের বাজেটে। করোনাকালের কৃষিবাজেটকে আমরা কীভাবে পাঠ করবো? করোনাকাল, করোনার আগে ও করোনা-উত্তর দুনিয়ায় কৃষিকে ঘিরে যাবতীয় দেনদরবার কী মিটে গেছে না মিটে যাবে? কৃষির ওপর চেপে বসা বৈশ্বিক কর্তৃত্ব, দখল, উপনিবেশ কী নয়াউদারবাদী বাণিজ্যের কী অবসান হয়ে গেছে না করোনা-উত্তর সময়ে এসব কিছুই থাকবে না? যাহোক কৃষির এমন চলমান যাবতীয় তর্ক আর বাহাসের ভেতর থেকেই করোনাকালের কৃষিবাজেটকে আন্দাজ করতে হবে। জানি সবকিছু এক নিমিষে বা এক লহমায় বদলে যাবে না। করোনাকালের কৃষিবাজেট কেমন কৃষির স্বপ্ন দেখে? নিশ্চয়ই প্রবল রাসায়নিক ও যন্ত্রনির্ভর কৃষি উৎপাদন নয়। বিশ্বাস করি, গ্রামীণ জনগণের বহুমুখী শ্রমের সমন্বয়ে এক জনমুখী ‘পরিবেশবান্ধব’ কৃষিখাত গড়ে তোলার স্বপ্নই দেখছে রাষ্ট্র। চলতি আলাপে সরাসরি আটখানা প্রস্তাব আবারো সামনে আনছি, আশা করি রাষ্ট্র ঘোষিত কৃষিবাজেটের চেহারাকে পরিবেশমুখী করে তোলার জন্য প্রসারিত করবে সকল দুয়ার।
করোনা স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণে কৃষকের জন্য বিশেষ বরাদ্দ
করোনাকালে কৃষিমন্ত্রণালয় বিশেষত বোরো মওসুমে ধান কাটার সময় অবিস্মরণীয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। কৃষিশ্রমিকের করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য কিছু বিধি ও বরাদ্দ তৈরি করেছিল। দেখেই চট করে বোঝা যায় সেটি করোনাকালিন সময়ের। কিন্তু করোনাকালের কৃষিবাজেটে মানুষসহ পরিবেশের স্বাস্থ্যঝুঁকি সুরক্ষার কোনো সুস্পষ্ট প্রতিফলন নেই। করোনাকালের কৃষিবাজেটে কৃষির সাথে জড়িত কৃষক ও কৃষিপরিবারের জন্য করোনা স্বাস্থ্যবিধির উপকরণসহ চিকিৎসাব্যয় বিষয়ক বিশেষ স্বাস্থ্যসুরক্ষা খাত রাখা জরুরি। করোনাকালে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাই আমাদের প্রধান শর্ত। আর এই খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কোনোভাবেই এককভাবে কেবল মানুষের জন্য নয়, মানুষসহ চারপাশের দেখা-অদেখা সকল বৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের। তার মানে কৃষিবাজেটকে একইসাথে কৃষকের স্বাস্থ্য, মাটি-পানি ও বীজের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে। আর সকলের সুস্বাস্থ্যই এক স্বাস্থ্যকর কৃষি, যা আমাদের উপহার দেবে এক সবল গ্রামীণ কৃষিঅর্থনীতি।
প্রতি ইঞ্চি জমির প্রকৃত ব্যবহার নিশ্চিতকরণে বরাদ্দ
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আহবান জানিয়েছেন, দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির সফল ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু দেশে প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমছে কৃষিজমি। এখনো খসড়া হয়ে আছে ‘কৃষি জমি সুরক্ষা আইন’। মোট কৃষিজমির প্রায় ৫ শতাংশ হলো আবার চাষের আওতায় না আসা ‘পতিত জমি’। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুলাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’ প্রতিবেদন জানিয়েছে, দেশে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে পতিত জমির পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার শতক বা মোটাদাগে বললে প্রায় ১১ লাখ একর। যেসব জমিতে এবছর আবাদ হয়নি কিন্তু গত বছর হয়েছিল, সেসব জমি ‘অস্থায়ী পতিত’। অস্থায়ী পতিত জমির পরিমাণ ১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৫ হাজার শতক। পরিবারপ্রতি প্রায় এক শতক করে অস্থায়ী পতিত জমি আছে। আর যেসব জমি এখনো আবাদের আওতায় আসেনি সেসব ‘স্থায়ী পতিত’। এমন জমির পরিমাণ ৯ কোটি ৩১ লাখ ৫৯ হাজার শতক এবং পরিবার প্রতি প্রায় ৩ শতক করে অস্থায়ী পতিত জমি আছে। বিবিএস (২০১৮) সূত্রমতে দেশে ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৮১ হাজার ১২৭ একর পুকুর আছে। দেশের প্রতিটি গ্রাম কি শহরের বাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গার প্রকৃত ব্যবহারের জন্য দরকার সামগ্রিক জনপরিকল্পনা ও প্রাসঙ্গিক বরাদ্দ। কেবল রাষ্ট্র নয়, এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তি ও পরিবারকে। তবে গ্রামীণ প্রান্তিক জনগণের প্রতি ইঞ্চি জায়গার প্রকৃত ব্যবহারের ক্ষেত্রে বহুমুখী সৃজনশীল উদ্ভাবনী পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে বরাদ্দ ও সহযোগিতাকে প্রশস্ত করে আগানো জরুরি।
ভূমিহীন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের জন্য প্রণোদনা

দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে এক কোটি কৃষি পরিবার। এদের বড় অংশই ‘গণি মিয়া’। গণি মিয়ার সেই গল্প নিশ্চয়ই মনে আছে? যার নিজের কোনো জমি নাই বলে পরের জমিতে ফসল ফলায়। এরাই প্রায় ৬৫ লাখ পরিবার। ইতিহাস থেকে ইতিহাস এদের কতো নাম, কতো অভিধা। বর্গাচাষী, ভাগচাষী, ভূমিহীন কৃষক, কৃষিমজুর, কৃষিশ্রমিক, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। এদের জমিও নেই, দলিলও নেই। এমনকি মালিকের সাথে কোনো চুক্তিপত্রও থাকেনা কারো। কিন্তু সরকারের স্বল্পসুদের বা বিনাসুদের কৃষিঋণ সুবিধা পেতে হলে জমির দলিল বা চুক্তিপত্র জমা দিতে হয়। কিন্তু দেশের ৬৫ লাখ গণিমিয়ার পরিবার কিভাবে এইসব নথি জমা দেবে? তাহলে কি রাষ্ট্রের ৫০০০ কোটি টাকার কৃষি প্রণোদনা থেকে তারা বঞ্চিত হবে? কিংবা ক্ষুদ্র আয়ের কৃষক ও কৃষিউদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত ৩০০০ কোটি টাকা থেকেও কি এরা বঞ্চিতই থাকবে? একটিবার আমাদের স্মরণ করা জরুরি গত বোরো মওসুমেও এই কৃষিমজুরেরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়েছে দেশের খাদ্য। তুলেছে বোরো মওসুমের ধান। করোনকালের বোরো মওসুমের ধান উৎপাদনের পঁচাশি ভাগই এসেছে এই ‘ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের’ কাছ থেকে। মাত্র পনের ভাগ বোরো মওসুমের ধানের জোগান দেয় দেশের স্বচ্ছল জমিমালিক ধনী গৃহস্থ পরিবার। তাহলে কী রাষ্ট্রের কষ্টের বাজেট চলে যাবে এই জমিমালিক ধনী কিছু পরিবারে? তাহলে কৃষিখাতে ঘোষিত হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ কিভাবে ভূমিহীন, বর্গাচাষী, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা পেতে পারেন এর নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই করতে হবে।
কৃষিখাতে ভর্তুকি সরাসরি নগদে দেয়া হোক
উপাত্ত ও বিশ্লেষণসমেত তর্ক জারি আছে কৃষিখাতে দিন দিন ভর্তুকি কমছে। আর ভর্তুকি বহাল থাকে মূলত ইউরিয়া, ডিজেলসহ দামি কৃষিপণ্য উপকরণ খাতে। এর বেশির ভাগই উৎপাদন করে কর্পোরেট কোম্পানিরা। রাষ্ট্রের ভর্তুকির টাকা কৃষকদের মাধ্যমে শেষমেশ এসব বড় কোম্পানির পকেটেই যায়। এবারের বাজেটে ৯৫০০ কোটি টাকা কৃষিতে ভর্তুকি হিসেবে রাখা হয়েছে। করোনাকালে এই কৃষিভর্তুকি কি সরাসরি নগদে দেশের ৬৫ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক পরিবারে দেয়া সম্ভব? যারা এ দিয়ে নিজের বাড়িতে একটি বীজঘর তৈরি করবেন বা দশে মিলে গ্রামে একটি ‘গ্রামীণ বীজব্যাংক’। কিংবা গলাছিলা মুরগি, পাাতি হাঁস, দেশি ছাগল বা গরুর একটা ছোট খামার। কিংবা ভূ-উপরিস্থ পানিকে ব্যবহারের জন্য লোকায়ত সেচব্যবস্থাকে চাঙ্গা করতে। কিংবা স্থানীয় উপকরণ দিয়ে উপযোগী কৃষিযন্ত্রপাতি তৈরি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তাহলে কৃষক পরিবার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে পরিবার ও এলাকা উপযোগী কী ধরণের উদ্যোগ তার বাস্তবায়ন দরকার। এতে ভর্তুকীর টাকা একটি গ্রামীণ সমাজে নানাভাবে বিন্যস্ত হবে। কৃষিতে কোম্পানিমুখী উপকরণ নির্ভরতা কমে একটা পরিবেশমুখী গ্রামীণ স্বনির্ভরতার ব্যাকরণ তৈরি হবে।
ঢালাও যান্ত্রিকীকরণ নয়, দরকার শ্রমের বহুমুখী সমন্বয়
চলতি আলাপের এই অংশ কোনোভাবেই ‘যন্ত্র বনাম জীবন’ জাতীয় কোনো অযথা তর্ককে টানছে না। কারণ সমতলের কৃষিতে ঐতিহাসিকভাবে ব্যবহৃত লাঙল কি মই বা জুমে ব্যবহৃত জোঙ্গা ও কাঠিও এক একটি কৃষিযন্ত্র। একটা সময় আমন-আউশ কী পাটের জমিনে নিড়ানী দিয়ে জীবন চলতো অনেক পরিবারের। দেশে দেশে প্রচলিত এমন কত নিড়ানির গান আশির দশক থেকে একেবারেই দুম করে হারিয়ে গেল। নিড়ানীপ্রথাকে সরিয়ে এলো মনস্যান্টোর রাউন্ডআপ আর সিনজেনটার রিফিট। মানে ‘আগাছানাশক’। এলো নানানামের ও দামের নিড়ানীযন্ত্র। এতে জমিমালিকের কিছু চাষের খরচ কমেছে। আর যারা জমিনের ঘাস বেছে জীবন চালাতো তারা হয়েছে কর্মহীন। এরাই শেষমেশ শহরে এসে রিকশাঅলা কি দিনমজুর হিসেবে নিজেকে হারিয়ে আছে কতকাল। কিন্তু সামগ্রিক বাস্তুসংস্থানে কী ঘটেছে? গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি কি মানুষ হারিয়েছে অনেকে পুষ্টিকর খাদ্য ও ভেষজের উৎস। শুনশুনি, বথুয়া, হেলেঞ্চা, থানকুনি, গিমা, বউটুনি, ব্রাহ্মী, কালাকেউতা, শ্যামাকলা এদের নির্বংশ হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির আগানাশক বোতলের গায়ে এদের ছবি দিয়ে লেখা থাকে এরা ‘আগাছা’। এই প্রক্রিয়ায় কেবল কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য উৎসের বিনাশ নয়, সামগ্রিক এক মনোজাতিক বদল ঘটেছে গ্রামীণ কৃষিপরিসরে। চলতি বাজাটে কৃষির যান্ত্রিকীকরণের জন্য ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ত্রিশটি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চল কী স্থানীয় কৃষিসংস্কৃতি কি এখনি আমূল যান্ত্রিকীকরণের জন্য প্রস্তুত? দেশের সবখানেতেই কী ঢালাওভাবে যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব? হয়তো বছর বছর বোরো মওসুমে ফসল কাটার সময়ে কৃষিশ্রমিকের সংকট থেকেই এই চিন্তা করা হচ্ছে। কিন্তু এই করোনাকালে তো শ্রমের সংকট নেই। বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০.৬ ভাগ মানুষ কৃষিতে জড়িত। এডিবি বলছে, করোনাকালে কাজ হারাতে পারে প্রায় নয় লাখ মানুষ। গার্মেন্টসে শ্রমিক ছাঁটাই নিয়ে কথা হচ্ছে। কয়েক লাখ প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসছে। তাহলে করোনাকালে কাজহারানো এই বিপুল বেকার মানুষেরা যাবে কোথায়? তাদের শ্রমশক্তি কোথায় কাজে লাগবে? আমাদের সামনে কৃষিই একমাত্র উপায়। তাহলে কৃষিযান্ত্রিকীকরণের বাজেটকে এই সময়ে দেশের বেকার ও কাজহারানো শ্রমশক্তির পেছনে ব্যয় করাই শ্রেয়। আর এই চলমান কৃষিধারাই হয়তো খুঁজে নেবে তার উপযোগী সব যন্ত্রকারিগরি।
নারীর জন্য কৃষিখাত
নারীই কৃষির উদ্ভাবক আর বীজের ঐতিহাসিক সংরক্ষক। কিন্তু কৃষি বাণিজ্যিকরণের নামে নারীর বীজ ভান্ডার আজ লুন্ঠিত। কৃষিখাত থেকে গ্রামীণ নারীর একটা বড় অংশ আজ গার্মেন্টসশ্রমিক। কিন্তু এই করোনাকালেও যখন দেশদুনিয়া লকডাউন হয়ে আছে, যখন কর্পোরেট কোম্পানিদের বীজের দোকান বন্ধ। তখন গ্রামে গ্রামে নারীরাই নিজেদের সংরক্ষিত বীজ একের সাথে অন্যে বিনিময় করেছেন। করেছেন শস্য ফসল বিনিময়। পরিসংখ্যানে ক্ষুদ্র হলেও করোনাকালে নারীর এই বীজবিনিময় শক্তি প্রমাণ করে এখনো গ্রামীণ নারীদের মাধ্যমেই দেশের বীজখাত স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা সম্ভব। যাতে করোনা-উত্তর সময়ে কোনো কোম্পানির ওপর আমাদের নির্ভর করতে না হয়। গ্রামীণ নারীর বসতবাড়ি ও পুষ্টিবাগানগুলো করোনাকালে পরিবার ও প্রতিবেশীর খাদ্য-পুষ্টির জোগান দিয়েছে। দেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ পুরুষ পেশা বদলায়। কিন্তু কৃষিতে গত দশ বছরে নারীদের অংশগ্রহণ আরো বেড়েছে। যদিও পুরুষতান্ত্রিক কৃষিময়দানে নারীর কৃষিঅবদানের যথাযথ স্বীকৃতি নেই। গ্রামীণ নারীর কৃষিখাত এবং কৃষির সকলস্তরে নারীর জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ এবং এসব বাজেট প্রাপ্তি ও ব্যবহার প্রান্তিক গ্রামীণ নারীর অগ্রাধিকার জরুরি।

জাতীয় কৃষি কমিশন গঠন
করোনাকালের বোরো মওসুমে প্রতি মণ ধানের দাম সরকার নির্ধারণ করে ১০৪০ টাকা। সরকার নির্ধারিত মাত্রায় কিছু ধান-চাল কিনেছে। বাদবাকী ধান বেচে কৃষকের এবারো চাষের খরচ জোটেনি। কেবল ধান নয় মওসুমভিত্তিক সকল শস্যফসল ও গ্রামীণ কৃষি উৎপাদন বিপণন, পরিবহন, মজুতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষিমুখী শিল্প বিস্তারে রাষ্ট্রকে এখনি সোচ্চার হতে হবে। আর এক্ষেত্রে বিশেষ বরাদ্দ রাখাও জরুরি। ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ থেকে শুরু করে কৃষির সামগ্রিক সমন্বয়ের জন্য ‘জাতীয় কৃষি কমিশন’ গঠন এখন সময়ের দাবি। করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রামীণ নারীর বীজভান্ডার থেকে শুরু করে কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার সবই এর আওতায় আসতে পারে। স্থানীয় কৃষক, কৃষক সংগঠন, স্থানীয় সরকারের স্ট্যান্ডিং কমিটি, গণমাধ্যমকর্মী, জনপ্রতিনিধি, উপসহকারী কৃষিকর্মকর্তা, সামাজিক সংগঠন, গবেষক, স্বাস্থ্যকর্মী, উন্নয়ন প্রতিনিধি, যুব প্রতিনিধি, বাজার কমিটি, উদ্যোক্তা সকলে মিলেই স্থানীয় পর্যায়ে এই কমিশনের কাজকে অবিচল রাখতে পারে।
কোম্পানি নয়, কৃষকের ওপর আস্থা রাখতে হবে
চলমান খাদ্যদুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে ইউরোপ ও মার্কিনের হাতেগোণা কয়েকটি বহুজাতিক খাদ্যকোম্পানি। কিন্তু কারখানাভিত্তিক এমন খাদ্যের নিরাপদ মান নিয়ে বৈশ্বিক তর্ক ওঠেছে। করোনাকালে ইতোমধ্যেই এসব কোম্পানি তাদের ভোল পাল্টাচ্ছে। করোনা-উত্তর সময়েও তারা ‘দূষণমুক্ত’, ‘রাসায়নিকমুক্ত’, ‘নিরাপদ’, ‘প্লাস্টিকমুক্ত’ ও ‘পরিবেশসম্মত’ এসব নয়ামোড়কে বৈশ্বিক খাদ্যসম্ভার দখলের পাঁয়তারা করছে। ইতোমধ্যেই ঘবংঃষব, এঊঅ, ইঁযষবৎ, এরাধঁফধহ, ইধৎৎু ঈধষষবনধঁঃ, ঝঁফুঁপশবৎ, অসপড়ৎ এই খাদ্যপণ্য কোম্পানিগুলো করোনা-মহামারী মোকাবেলা করে নিরাপদ উপায়ে খাদ্য উৎপাদনের অভিনব কৌশলগুলো এক জায়গায় নিয়ে আসার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। করোনাকালে সবকিছু লকডাউন হলেও নির্ঘুম হয়ে আছে কৃষক, কৃষি ও কৃষিজীবন। আমরা মাস্ক, স্যানিটাইজার, অক্সিজেন নিয়ে তর্ক করছি। দাম নিয়ে, মান নিয়ে, পাওয়া না পাওয় নিয়ে। কিন্তু চারপাশে চাল-সবজি-মাছ-মাংশ-ফলমূল সবই কিন্তু কোনো না কোনোভাবে মিলেই যাচ্ছে। দেশ খাদ্যশূণ্য হয়ে পড়েনি। এর যাবতীয় পরিশ্রম স্বীকৃতিহীন মর্যাদাহীন গ্রামীণ কৃষকের। করোনাকালে আসুন, একটিবার কৃষকের মর্যাদার জন্য লড়ি। কৃষকের ওপর উন্নয়নের আস্থা জোরদার করি। করোনাকালের ঘোষিত কৃষিবাজেট এক পরিবেশমুখী কৃষির স্বপ্ন নিয়ে দেশের পরিশ্রমী কৃষকের জন্য সকল দুয়ার উন্মুক্ত করবে এই প্রত্যাশা আবারো।

happy wheels 2