করোনাকাল: চিরচেনা বস্তির অচেনা চিত্র

ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল:
রিক্সাটা বরাবরের মতই চাঁদ উদ্যানের লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি আর জাহাঙ্গীর ভাই ( মো. জাহাঙ্গীর আলম) যখন গেট দিয়ে ঢুকছি সেই পরিচিত দোকানটা খোলাই ছিলো আর তার সামনে একই জটলা, রাস্তাটা বৃষ্টির পানিতে কাদাময়। সামনে এগুতেই ইয়ানুর আপার বাসার সামনের পানি নেয়ার জন্য বিশাল জটলা। আমাদের দেশে ৫/৭ জন প্রায় দৌড়ে আসলেন, আপনেরা কই আছিলেন, কেমন আছেন এই কুশলাদির অন্ত নাই। এরই মাঝে একজন বলতে শুরু করলেন মুন্নার বাবা মারা গেছে স্ট্রোক করে। সখিনার আপার বাবাও মারা গেছে। ইয়ানুর আপার স্বামীর দোকানটা বন্ধ কেন জানতে চাইলে তার মেয়ে জানালো দোকানে মাল নাই তো খুইলা কি করমু। কিন্তু যারাই এগিয়ে এসে কথা বলতে শুরু করলেন তাদের কারো মুখেই মাস্ক নেই। এমনকি পুরো বস্তিতে ঘুরেও কারো মুখে মাস্ক দেখলাম না। কেন মাস্ক পরেন না জানতে চাইলে একজন স্পষ্ট করে বলে দিলেন, তাদের এসব রোগ হবে না! যাই হোক সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।


মৌমিতার মা এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন আমাদের মিটিং আবার কবে শুরু হবে। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না, বস্তির প্রায় সকলেই কর্মহীন। বাসা বাড়ির কাজে প্রায় কেউই নেয় না। আবার যার ৩/৪ টা কাজ ছিলো তিনি করছেন একটা কাজ। তাদের জন্য আমরা কিছু করতে পারবো কিনা, কোন সহযোগিতা করা যাবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
পানির কল থেকে ডানে ঘুরতেই কোনায় এক নারী মাটিতে কাগজ বিছিয়ে কিছু আধা নষ্ট সবজি বিক্রির চেষ্টা করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম বিক্রি হচ্ছে কেমন, তিনি খুব করুণ মুখ করে বললেন, ‘এই চলে আর কি ভাই। কি আর করমু কাম কাজ নাই, খাওন নাই তাই বসে থাকি এগুলো নিয়ে।’


সামনে এগুতেই শাহনাজ আপার বাসা। সামনের দোকানটায় বসে নেই সেই পরিচিত নারীটি। সেই দোকানে এখন আরেকজন বসে আছে। কোথায় জানতে চাইলে বললেন, ‘তারা দেশে গেছে।’ এমন অনেকেই দেশে চলে গেছেন বলে জানালেন বস্তির মানুষেরা। অনেকেই স্থায়ীভাবেও চলে গেছেন অভাবে থাকতে না পেরে। অনেকে আবার গ্রাম থেকে ফিরেও এসেছেন। কেউ কেউ ঈদের পর এখনো ফেরেননি।


মুন্নার মা ঘরের দরজায় বসে কাজ করছিলেন। আমাকে দেখে কাজ বন্ধ করে বের হয়ে আসলেন। কথা বলা শুরু করলেন জাহাঙ্গীর ভাই আর আমার সাথে। তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে একটা খাবারের প্যাকেট পাঠিয়েছিলাম সেটাও সে স্মরণ করলেন। অনেক সময় নিয়ে তার স্বামীর মৃতু্যূর ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন আবেগে আপ্লুত হয়ে। তার কথায় আস্তে আস্তে আশপাশের পরিবেশও ভারী হয়ে উঠলো। মুন্না এসেও আমাদের সাথে যোগ দিলো। খুব কষ্টের একটা জীবন তাদের এখন। বারসিক’র সহযোগিতায় তার স্বামীর বয়স্ক ভাতা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি অফসোস করতে লাগলেন। পরবর্তী কাজ সম্পর্কে জাহাঙ্গীর ভাই তাকে বুঝিয়ে দিলেন।


যাহোক দীর্ঘদিন পর বসিÍতে গিয়ে আজ একটা ধাক্কা খেলাম মনে হয়। এক ভয়াবহ পরিস্থিতি আমরা আজ বস্তিতে গিয়ে দেখতে পেলাম। এ বস্তি আমাদের চিরাচরিত চেনা পাইওনিয়র হাউজিং বস্তি বা সোনা মিয়ার টেক নয়, এটা যেন ভিন্ন জায়গা আর মানুষগুলোও কেমন বদলে গেছে। এ করোনাকালে ক্ষুধা ও দারিদ্র তাদের মারাত্মক সংকটে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাদের যেমন কাজ নেই, নেই খাদ্য , নেই স্বাস্থ্যসেবার ন্যূনতম নিশ্চয়তা। তাই তারা জানেন না ‘যে বস্তিতে কারও করোনা হয় কিনা, হচ্ছে কিনা’ কারণ তারা কখনই করোনা টেষ্ট করাননি! এ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাদের খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি, তাদের কাজে ফেরার নিশ্চয়তাটা অত্যন্ত জরুরি। আর সবচেয়ে জরুরি তাদের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা। সরকার নিশ্চয়ই এ দিকগুলো বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে এই মানুষগুলোর পাশে দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়াবে। আমরা সে প্রত্যাশাই করি।

happy wheels 2