আমি এখন আর দিনমজুর নই- কৃষক মাইনুল ইসলাম

রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম শহিদ ও অমিত কুমার সরকার

সমাজে কিছু মানুষ থাকে যাদের ইচ্ছা শক্তি, উদ্যোগ ও কঠোর পরিশ্রমে পরিবর্তন আনে জীবনে চলার পথে। নিজস্ব চিন্তা ও স্থানীয় জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পরিবর্তন করে নিজের অবস্থান। তেমনই একজন কৃষক রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছী ইউনিয়নের ছোট আমগাছী গ্রামের কৃষক মো. মাইনুল ইসলাম (৩৩+)।

তিন ভাই ও এক বোনের পরিবারে মাইনুল সবার ছোট। অভাবের সংসারে স্কুলের পথে বেশি দিন না যেতে পারলেও ১২ বছর বয়স থেকেই মানুষের বাড়িতে শ্রম বিক্রি শুরু করেন মাইনুল। কম বয়সে বিবাহিত জীবন আসার পর আর্থিকভাবে আরও অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। ২০০৩ সালে শুধু বাড়ির ভিটাসহ পরিবারকে নিয়ে পৃথক হয়ে যেতে হয়। তখন থেকেই মানুষের বাড়িতে কাজ করার পাশাপাশি জমি বর্গা নিয়ে নিজেই ফসল চাষ শুরু করেন।
Mainul
২০১২ সালে পার্শ্ববর্তী এলাকা ডাকপুর থেকে পটলের চারা সংগ্রহ করে মাইনুল। তিন বিঘা জমিতে পটলের চাষ করেন। কিন্তু চারা খারাপ হওয়ার কারণে গাছ ভালো হলেও কোন ফল না ধরায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন তিনি। এই ক্ষতিই তার জীবনে পরিবর্তন এনে দেয়। ২০১৩ সালের  প্রথম দিকে তিনি নিজেই বাড়ির আঙ্গিনায়  এক হাজার পটলের চারা তৈরি করেন। সেখান থেকে তিনি ৫০০ চারা এলাকার কৃষকদের কাছে বিক্রয় করেন। বাকি চারা নিজে লাগান। এই উদ্যোগে অনেক লাভবান হন তিনি। সেখান থেকেই তার যাত্রা শুরু। পরের বছর (২০১৪) বাড়ির পাশে ৩ কাঠা জমি লিজ নিয়ে বিশ হাজার পটলের চারা তৈরি করেন মাইনুল। এই চারা তৈরিতে ১৫ হাজার টাকার মত খরচ হলেও প্রতিটি চারা ৪ টাকা করে মোট আশি হাজার টাকায় চারা বিক্রয় করেন তিনি। সেই টাকায় তিন কাঠা জমি কিনে শুরু করেন  মরিচ, বেগুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি ও পটলের চারার নার্সারি। মূলতঃ চৈত্র থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত জিয়া ও মেহেরপুরী জাতের মরিচের চারা উৎপাদন করে বাজারজাত করেন। পাশাপাশি ভাদ্র থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত ফুলকপি, বাঁধাকপি ও বেগুনের (চাইনা, যশোর, ইন্ডিয়ান জাত) চারা উৎপাদন করে বাজারজাত করেন। অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ পর্যন্ত সাইটা, বোম্বাই, এবং দেশী জাতের পটলের চারা উৎপাদন করে বাজারজাত করেন তিনি। কৃষক মাইনুল বলেন, “আমি এখন ভালো আছি। মানুষের ঘরে আর কাজ করতে হয় না। আমার ভাবতে ভালো লাগে যে, আমি এখন আর দিনমজুর নই।”

এবছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে মো. মাইনুল তার নার্সারিতে ২০ হাজার টাকা খরচ করে ২৭ হাজার পটলের চারা তৈরি করেছেন। তার নার্সারি থেকে নিজ গ্রাম ছাড়াও পার্র্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোর মধ্যে মোহনপুর, নওহাটা, চাঁদপুর, নওপাড়া, হরিফেলা, মৌগাছি, দাওকান্দি, কালিগঞ্জ, মহনগঞ্জ, হারদো, দামকুড়াসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষক সবজির চারা সংগ্রহ করেন। চলতি বছরে তিনি প্রায় ২৫ হাজার টাকার চারা বিক্রয় করেছেন। তিনি এই বছর এক লাখ টাকার পটলের চারা বিক্রয় করতে পারবেন বলে আশা করছেন। তার এই উদ্যোগে সফলতা দেখে একই গ্রামের কৃষক আল আমিন শুরু করেছেন পটলের চারা উৎপাদন।

কৃষক মাইনুলের এই উদ্যোগ পরিবর্তন ঘটিয়েছে তার জীবনের। এখন তার মানুষের বাড়িতে আর শ্রম বিক্রয় করতে হয় না, তেমনি অর্থের অভাবে লেখাপড়া বন্ধ করতে হচ্ছে না তার দুই সন্তানকে (এক ছেলে এক মেয়ে)। শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি ও উদ্যোগ গ্রহণের সাহসিকতাই পরিবর্তন এনে দিতে পারে একটি মানুষ ও তার পরিবারের, কৃষক মাইনুল তার উদাহরণ। তেমনি কৃষির উন্নয়নের ক্ষেত্রে রেখে চলেছে বড় ভূমিকা।

happy wheels 2