মালশিরা ধানে ভরে গেছে আশুজিয়ার কৃষকদের মাঠ

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
কৃষি বিষয়ক নতুন কোন তথ্য ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের দ্রæততম মাধ্যম হলো আমাদের দেশের কৃষক। কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া গ্রামের একজন কৃষক আবুল কালাম। কৃষক আবুল কালাম আশুজিয়া গ্রামের ‘আশুজিয়া কৃষক সংগঠন’র সভাপতি। সংগঠনের মাধ্যমে তিনি আশুজিয়া ইউনিয়নের আশুজিয়া, নগুয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে কৃষি তথা কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগেও আশুজিয়া গ্রামের কৃষকদের কাছে দু’একটি উফশী/হাইব্রিড জাতের ধান ছাড়া তেমন কোন স্থানীয় ধানের জাত ছিলনা। কৃষক আবুল কালাম এলাকায় একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কৃষক হিসেবে পরিচিত। তিনি একজন গবাদী পশু-পাখির ভেক্সিনেটর ও চিকিৎসকও। তিনি সব সময় স্থানীয় জাতের ধান ও অন্যান্য ফসল চাষ করতে পছন্দ করেন। ধানের ফলন বেশি পাওয়ার জন্য গ্রামের কৃষকরা সাধারণত ব্রি-২৮, ২৯, ৩২, ৩৪, ৪৯ ও কালোজিরা ইত্যাদি জাতের ধানগুলো চাষ করতেন।


২০১৬ সালে সংগঠনের সভায় কৃষক আবুল কালাম স্থানীয় জাতের ধানের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলে সকল সদস্যরা মিলে এলাকা উপযোগি স্থানীয় ধানের জাত গবেষণা ও বীজ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৬ আমন মৌসুমে সংগঠনের সভাপতি কৃষক আবুল কালাম বারসিক’র উদ্যোগে আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের রামেশ্বরপুর গ্রামের ‘তুষাইপাড়ের কৃষক সংগঠন’ পরিচালিত কৃষক নেতৃত্বে ধানের প্রায়োগিক গবেষণা ও বীজ সংরক্ষণে বীজঘর পরিদর্শনে অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর করেন। অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর শেষে তিনি রামেশ্বরপুর বীজঘর থেকে ১০টি স্থানীয় জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যান এবং আশুজিয়া কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে আমন ২০১৬ মৌসুমে ১০ শতাংশ জমিতে এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনে কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।


ধান কাটার সময় হলে গবেষণা কার্যক্রমের ফলাফল এলাকার কৃষকদের সাথে সহভাগিতা ও এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনের জন্য সংগঠনের উদ্যোগে এক ‘কৃষক মাঠ দিবস’র আয়োজন করা হয়। মাঠ দিবসে এলাকার ১০জন কৃষক গবেষণাধীন ১০টি জাতের ধানের মধ্য থেকে ফলন ভালো, রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ কম, শীষ লম্বা ও দানা পুষ্ট, রং সুন্দর, হেলে পড়েনা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ‘মালশিরা’ ধানের জাতটি পছন্দ করেন। আমন ২০১৭ মৌসুমে ঐ পাঁচজন কৃষক নিজেদের জমিতে মালশিরা ধানের বীজ নিয়ে চাষ করে ভাল ফলন পায়। আমন ২০১৭ মৌসুমেও পুনরায় ধানের জাত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে এলাকার কৃষকেরা মালশিরা ধানের জাতটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিশেষভাবে মালশিরা ধানের প্রাপ্তি স্থান, বীজ পাওয়ার উপায় ইত্যাদি বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমন ২০১৭ মৌসুমের ধানের জাত গবেষণাকে কেন্দ্র করে এক কৃষক মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়। মাঠ দিবসে গবেষণার ফলাফল সকল অংশগ্রহণকারীদের সাথে সহভাগিতা করা হয়। মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারীরা সরেজমিনে গবেষণার মাঠ পরিদর্শন করে পছন্দের ধান কেটে মাড়াই করে অধিকাংশ কৃষক মালশিরা ধানের জাতটি এলাকা উপযোগি হিসেবে পছন্দ করেন।


২০১৬ আমন মৌসুমে গবেষণা প্লট থেকে বীজ সংগ্রহ করে যে ১০ জন কৃষক ২০১৭ আমন মৌসুমে নিজেদের জমিতে চাষ করেছিলেন তারাও মাঠ দিবসে উপস্থিত হয়ে মালশিরা ধানের ফলাফল সহভাগিতা করেন। অংশগ্রহণকারীরা ভাল ফলন, ধান ছোট ও সুগন্ধি হওয়ায় মালশিরা ধানটি পছন্দ করে ধানের বীজ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমন ২০১৮ মৌসুমে আশুজিয়া গ্রামের কৃষক আবুল কালাম তার ১.২০ একর (১২০ শতাংশ) জমিতে মালশিরা ধান চাষ করেছিলেন। গ্রামের আরও পাঁচজন কৃষক আবুল কালামের নিকট থেকে মালশিরা ধানের বীজ নিয়ে নিজেদের তিন একর (৩০০ শতাংশ) জমিতে চাষ করেন। আমন ২০১৮/২০১৯ মৌসুমে গ্রামের মালশিরা ধানকে কেন্দ্র করে বড় আকারে আশুজিয়া গ্রামে এক কৃষক মাঠ দিবস আয়োজন করা হয়েছিল। বীজতলায় বীজ বপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত মালশিরা ধানের মোট সময়কাল ১৩৯ দিন এবং গাঁথুনি ও দানার সংখ্যা বেশি, চিটা কম, দানা মাঝারী চিকন ও চাল সাদা বর্ণের বর্ণের হওয়ায় কৃষকরা এ জাতটি খুব পছন্দ করেন। মাঠ দিবসে কৃষকরা মালশিরা ধান কেটে মাড়াই ও ওজন করে প্রতি ১০ শতাংশ জমিতে ১৮০-২০০ কেজি (৪-৫ মণ/কাঁচা মাপে) ফলন পেয়েছেন। অনুষ্ঠানে চারটি গ্রামের ৮ জন কৃষক ৫ কেজি করে মোট ৪০ কেজি মালশিরা ধান বীজ গবেষণা কমিটির নিকট থেকে আগামী মৌসুমে চাষ করার জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে যান।


আশুজিয়া গ্রামের কৃষক আবুল কালাম ২০২০ আমন মৌসুমে ‘মালশিরা’ ধানটি এলাকার অধিকাংশ কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে বলে করেছিলেন। বীজের জন্য বাজার নির্ভশীলতা কমাতে তিনি আমন ২০২০ মৌসুমের জন্য ৫ মণ মালশিরা ধানের বীজ সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। সংরক্ষিত বীজ থেকে ২০২০ আমন মৌসুমে তিনি আশুজিয়া গ্রাম ছাড়াও পাড়াদূর্গাপুর, নগুয়া, রাজিবপুর, কছনধারা এবং মদনপুর ইউনিয়নের মনাং গ্রামের ৬ জন কৃষাণীসহ প্রায় ৭০/৭৫ জন কৃষক-কৃষাণীকে মালশিরা ধানের বীজ বিনামূল্যে দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।


বীজ সহযোগিতা পেয়ে আশুজিয়া, বলাই শিমূল ও মদনপুর ইউনিয়নের যেসকল কৃষক আমন ২০২০ মৌসুমে মালশিরা ধান চাষ করে সফল হয়েছেন তাদের মধ্যে কৃষক এখলাছ, মজিদ, লিটন, আবুল, আলিম, সোনাবানু, তুষার, কাদির, জাকির, জামির, আলি, আকবোর, রাসেল, হক, সুজন, কালাম, আজিজ, নুরুলইসলাম, মালেক, জাহেদ, রতন, সিরাজ, স¤্রাজ, রফিকুল, আলমগীর, কাদির, আলামিন, রহিম, হেকিম, জব্বার আলী, আলেহা, সবুজ, রেজিয়া, সাত্তার, ফারুক, হায়দার, শার্লি, তৈয়ব, মান্না, মতি, মূলেদা, মমতা, খোকন, রাব্বী উল্লেখযোগ্য। তিনটি ইউনিয়নে আমন ২০২০ মৌসুমে প্রায় ২৭০০ কাঠা (১ কাঠা=১০ শতাংশ) বা ২৭০ একর জমিতে মালশিরা ধান চাষ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কৃষক একলাছ মিয়া বলেন, ‘মালশিরা ধানে পোকার আক্রমণ কম, উঁচু ও নিচু উভয় ধরণের জমিতে এ ধান চাষ করা যায়, উৎপাদন খরচও কম, ফলন ভালো, রং ভালো ও খেতে সুস্বাদু, বাতাসে গাছ হেলে ও ধান ঝড়ে পড়ে না, চিটা কম হয়, এলাকার মাটি ও আবহাওয়ার সাথে মানানসই ইত্যাদি কারণে এলাকার কৃষকরা মালশিরা ধানটি পছন্দ করে চাষ করেছেন। ২০২১ আমন মৌসুমে এলাকার সকল গ্রামের ধানের জমিতে মালশিরা ধানের জাতটিতে সয়লাব হবে বলে আমরা আশা করছি।’


বর্তমান আধুনিক কৃষি মূলত বহুজাতিক কোম্পানির বীজ ও কৃষি উপকরণনির্ভর। কোম্পোনির আকর্ষণীয় বিজ্ঞপনে ও প্রচারণায় আমাদের কৃষকরা আকৃষ্ট হয়ে আধুনিক ও হাইব্রিড জাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় আশুজিয়া গ্রামের কৃষকরা কোম্পানির প্রচারণার উপর নির্ভরশীল না হয়ে বারসিক’র সহযোগিতায় এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচন করে তাদের পছন্দের মালশিরা ধানটি নির্বাচনে সক্ষম হয়েছেন। মালশিরা ধানের জাতটি কেন্দুয়া উপজেলার সকল গ্রামের কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে এটাই কৃষক আবুল কালামের চাওয়া। আবুল কালামের ন্যায় দেশের সকল অঞ্চলের কৃষকরা নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী স্থানীয় ধানের জাত নির্বাচনে এগিয়ে আসলে দেশের সকল এলাকার জন্য উপযোগি ধানের জাত পাওয়া সম্ভব হবে বলে আবুল কালাম মনে করেন। এক সময় বাংলায় প্রায় আঠার হাজারেও বেশি ধানের জাত ছিল। এই জাতগুলোর এখনও প্রায় তিন হাজারেরও বেশি জাত কৃষকদের নিকট রয়েছে। এর মধ্য থেকে নিশ্চয়ই এলাকা উপযোগি জাত কৃষকরা খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে। কৃষকদের প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই সফল হবে একদিন। মালশিরার মত বৈচিত্র্যময় ধানে ভরে উঠবে কৃষকদের গোলা। ভোক্তা পাবে বৈচিত্র্যময় খাবারের স্বাদ।

happy wheels 2

Comments