স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চাকারী হরিশ চন্দ্র শীল

নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রানী সিংহ
প্রাকৃতিক ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে একেকটি অঞ্চলের বৈচিত্র্যতা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি অঞ্চল ভেদে কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যেও রয়েছে বেঁচে থাকার বা টিকে থাকার ভিন্নতা। প্রত্যেকটি পরিবারের রয়েছে বংশপরম্পরায় ভিন্ন ভিন্ন পেশা, রীতি-নীতি, চর্চা ও টিকে থাকার বিশেষ কিছু কৌশল ও সক্ষমতা। কোন কোন আদি পেশা, রীতি নীতি ও চর্চা মানুষ মন থেকে পরম বিশ্বাসে পালন করে, কোন মানুষ এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেও কোন কিনারা করতে পারেনা।

আজ এমনই একজন কৃষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়াস করছি, যিনি আদি পেশাকে জীবিকায়নের একমাত্র কৌশল হিসেবে আকড়ে ধরে আছেন। যে পেশা বর্তমানের অস্থিতিশীল অর্থনীতি বা দ্রুত পরির্বতনশীল পরিবেশে তাকে বেঁচে থাকার পথ তৈরি করে দিয়েছে। তিনি নেত্রকোনা সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের একজন কৃষক হরিশ চন্দ্র শীল (৪৫)। বংশানুক্রমে দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর ধরে ধান বীজ ও বিভিন্ন জাতের সবজি বীজ সংরক্ষণ ও বীজ থেকে চারা উৎপাদন ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।

নেত্রকোনা জেলার অধিকাংশ এলাকাই হাওর অধ্যুষিত, হাওর এলাকার জন্য এই এলাকার কৃষকদের পক্ষে অতিবৃষ্টির ফলে জমিতে পানি জমে যাওয়ায় আমন ধানের বীজতলা ও সবজির বীজতলা তৈরি করা সম্ভব হয় না। কিছু সময়ের জন্য এই এলাকার অনেক জমি পতিত পড়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমে জমিতে তেমন কাজ না থাকায় কৃষক হরিশ চন্দ্র পারিবারিক আয়ের উৎস হিসাবে হাওর বা নিচু এলাকার কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী ধানের চারা, যেমন-বিরই, ইয়রচাল, ব্রিধান-৩৪ ইত্যাদি পতিত জমিগুলোতে উৎপাদন করে পরবর্তীতে বিক্রি করেন। প্রায় ৬০ বছর ধরে দাদা ও বাবার পর কৃষক হরিশ চন্দ্রও এই কাজটি ধরে রেখেছেন। ধানের চারা উৎপাদনের পাশাপাশি তিনি নতুন করে বৈচিত্র্যময় সবজি চারা যেমন-টমেটো, মরিচ, বেগুন, লাউ, সীম, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি উৎপাদন করে গ্রামের কৃষক ও বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধির পথ উন্মোচন করেছেন। বর্ষাকালীন সময়ে চারা বিক্রি থেকে উপার্জিত অর্থ তিনি ব্যবহার করেন সংকটকালীন সময়ে পরিবারিক চাহিদা মেটাতে এবং শীতকালীন সবজি চাষের জন্য জমি প্রস্ততির কাজে। চারা উৎপাদনের জন্য ৩/৪টি ভিটি জমি তিনি সর্বদা প্রস্তুত করে রাখেন। এছাড়াও তিনি লোকায়ত পদ্ধতিতে মাটির নিচে কচুমুখী ও হলুদ বীজ লোকায়ত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করেন।

বর্তমান সময়ে কৃষক হরিশ চন্দ্র শীল নূরপুর গ্রামে কৃষি বিষয়ে অভিজ্ঞ কৃষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সংসারের আয়ের একটা বড় অংশ আসে তার বছরব্যাপী শাকসবজি চাষাবাদের পাশাপাশি ধান ও সবজির চারা বিক্রি, হাঁস মুরগি ও গরু-ছাগল পালন থেকে। বর্তমানে তার পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৬ জন (নারী-২ ও পুরুষ-৪)। তার মোট জমি ৩৫ কাঠা (৩৫০ শতাংশ), এর মধ্যে বসতভিটা এক কাঠা, কৃষি জমি ২৮ কাঠা ও পুকুর ৬ কাঠা। পরিবারের ৪ জন সদস্য কৃষির বিভিন্ন কাজে যেমন- ফসল উত্তোলন, সংরক্ষণে তাকে সহযোগিতা করেন। তিনি সারাবছর পর্যায়ক্রমে কচু, লতা, বেগুন, পালংশাক, সরিষা, টমেটো, শিম, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, ডাটা, কলমিশাক, মরিচ, পুইঁশাক, ঢেড়স, কুমড়া, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, করলা, কাকররোল, শসা ও পাটশাক পুকুরপাড়ে ও জমিতে চাষ করেন।
অন্যান্য ফসলের মধ্যে আদা, হলুদ, মাছ আলু, পাট, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, গুয়ামুড়ী, লইন চাষ করেন। উৎপাদিত এসব ফসল দিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে তিনি বাজারে বিক্রি করেন এবং প্রতিবেশীদেরকেও শাকসবজি ও বীজ দিয়ে থাকেন। নিজের উৎপাদিত সবজি ছাড়াও তিনি বাড়ির চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাদ্য উদ্ভিদ যেমন-কচু, লতা, লজ্জাবতী, ঘৃতকাঞ্চন, অরহড় কলাই, গিমাই শাক, বথুয়া শাক, হেলেঞ্চা, থানকুনি, টিপবাহর ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিয়মিত খেয়ে থাকেন।

নিজস্ব ৬ কাঠা জমির পুকুর পাড়ে পেঁপে, লাউ ও শিম চারা উৎপাদনের পাশাপাশি সবজি চাষ করেন। এই পুকুর থেকে পরিবারের সদস্যদের সারা বছরের আমিষের চাহিদা পূরণ হয়। বর্ষা মৌসুমে কৃষক হরিশ চন্দ্র শীল গ্রামের ছোট ছোট জলাশয় থেকে স্থানীয় জাতের মাছ ধরেও আমিষের একটি বড় অংশের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। বর্ষাকালে জলাশয়ে মাছের প্রাপ্যতা বেশি হলে উদ্বৃত্ত্ব মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। বর্তমানে তিনি বাড়িতে ৬টি গরু পালন করছেন। গরুর গোবর তিনি সবজির জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করেন।

২৮ কাঠা কৃষি জমিতে তিনি দু’টি মৌসুমে ৭ জাতের ধান, যেমন- ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, বিরই, ব্রি-৪৯, ব্রি-৩২, ব্রি-৩৪ ও চিনিশাইল চাষ করেন। বাড়ির চারপাশে তিনি বিভিন্ন ধরণের ফলদ গাছ- আম, জাম, কাঠাঁল, জলপাই, চালতা, লেবু ইত্যাদি রোপণ করেছেন। চলতি মৌসুমে (তিন মাসে) কৃষক হরিশ চন্দ্র শীল উৎপাদিত সবজি চারা বিক্রি করে দুই লক্ষ টাকা আয় করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। বর্তমানে অর্থনৈতিক বা প্রাকৃতিক পরিবেশ হোক পরিবর্তনশীল, টিকে থাকার জন্য পরিবেশসম্মত চর্চা স্থায়িত্বশীল জীবিকায়নের জন্য নতুন পথ উন্মোচন করে তারই প্রমাণ রেখেছেন কৃষক হরিশ চন্দ্র শীল।

happy wheels 2

Comments