গুচ্ছ গ্রামের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বারসিক’র উদ্যোগ

নেত্রকোনা থেকে অহিদুর রহমান
গণেশের হাওর, ডিঙ্গাপোতা হাওরের ঢেউয়ের আগ্রাসন এবং দুগনই হাওরের মাঝে গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রামের ৫০টি পরিবারের বসবাস। হাওরের দুর্যোগ তাদের নিত্যসঙ্গী। বিশাল জলরাশির মাঝে ভাসমান এক দ্বীপের মধ্যে প্রায় ৫০টি পরিবারের ২৩৫ জন মানুষের বসবাস। মদন উপজেলার হাওর অধ্যুষিত একটি ইউনিয়ন গোবিন্দশ্রী। ২০১৯ সালে গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নে দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবারের জন্য উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হয়। গুচ্ছগ্রামের ঘরগুলো হস্তান্তরের পর বারসিক গুচ্ছগ্রামের চারাপাশে পরিবেশ উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পরামর্শ অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় ফল ও পানি সহনশীল গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করে । বারসিক’র সহযোগিতায় ২০২০ সালে বন্যা পরবর্তী সময়ে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) গুচ্ছগ্রামের চারপাশে ৫০০টি হিজল ও করচ এবং ৩০০০ মূর্তা বেতের চারা, বিন্নাচুবা এবং ঢুলকলমি রোপণ করে একটি বেষ্টুনি গড়ে তোলা হয়। পাশাপাশি হাঁস মোরগ পালনের জন্য সহযোগিতা ও উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে বসতভিটার সামান্য জমিতে সবজি চাষের জন্য বারসিক গুচ্ছগ্রামবাসীদের উৎসাহিত করে এবং বৈচিত্র্যময় ১৭ জাতের সবজির বীজ বিতরণ করা হয় ৫০টি পরিবারে।

সবজি বীজ পেয়ে গুচ্ছগ্রামের ৫০টি পরিবার তাদের বসতভিটার সামান্য জমিতে (১.৫ শতক) বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেছেন। সরেজমিনে গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সকল বসতভিটার চারপাশ,ঘরে চালে, টাওয়ার পদ্ধতিতে বৈচিত্র্যময় সবজি যেমন-টমাটো, লাউ, মূলা, শিম, ডাটা, লালশাক, মিষ্টিকুমড়া, পুঁইশাক, চুকাই, কপি, ঢেড়স, পেয়াজ, রশুন, মরিচ, বেগুন, পেঁপে, আখ, পালংশাক, সরিষা শাক, পাটশাক, করলা ইত্যাদি ফসলে ৫০টি পরিবারে বসতভিটা ভরে গেছে। গ্রামবাসীরা জানায়, তারা নিজেদের উৎপাদিত সবজি খাচ্ছেন, বাজার থেকে তাদের কোন সবজি কিনে খেতে হয় না, বরং কিছু কিছু সবজি বাজারে বিক্রি করছেন।

এই প্রসঙ্গে গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘সরকার গুচ্ছগ্রামের প্রত্যেক পরিবারের জন্য ৩ শতাংশ করে জমি বরাদ্দ দিয়ে তাতে দুই কক্ষের একটি ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। ঘরের অংশটুকু বাদ দিলে প্রত্যেকের ১.৫ শতক করে জমি থাকে। এ জমিগুলোতে কিছু হবে না বলে আমরা ফেলেই রেখেছিলাম। কিন্তু বারসিক’র কর্মীরা এসে আমাদেরকে এই জমিগুলো ফেলে না রেখে সবজি চাষের জন্য পরামর্শ ও বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেন। আমরা বীজ পেয়ে নিজ নিজ ১.৫ শতাংশ জমিতে সবজি চাষ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি লাউ, মূলা, লালশাক, ডাটা, বেগুন, করলা, পুইশাক ও চুকাই চাষ করেছি। নিজেরা খাওয়ার পর ৪০০ টাকার মূলা এবং ৭০০ টাকার লালশাক বিক্রি করেছি। কিছু লালশাকের গাছ বড় করছি বীজ রাখার জন্য। ক্ষেতে এখনও অনেক মূলা রয়েছে। মাঁচায় লাউ ধরতে আরম্ভ করেছে। লাউ খাওয়ার পরও বিক্রি করতে পারব। বারসিক পরামর্শ না দিলে হয়তো আমরা জমিগুলো পতিত ফেলে রাখতাম।’

আরেক গুচ্ছগ্রামবাসী ফজলুল হক তার বসতভিটার সামান্য জমিতে টমাটো, বেগুন, মূলা, করলা, লাউ, মরিচ ইত্যাদি সবজি চাষ করেছেন। টমাটো ও লাউ গাছে ফল ধরেছে, মূলা ফলতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে ফজলুল হক বলেন, ‘বারসিক থেকে বীজ পেয়ে আমি বসতভিটার ১.৫ শতক জমিতে ৬ জাতের সবজি চাষ করেছি। মূলাশাক আমরা খাচ্ছি, লাউ ও টমাটো খাওয়ার উপযোগি হয়েছে। আশা করি নিজেরা খাওয়ার পরও বাজারে বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করতে পারব। আমি করলা, বেগুন, লাউ ও মরিচের বীজ নিজেই সংরক্ষণ করব এবং গুচ্ছগ্রামের যেসব পরিবারের এসব বীজ নেই তাদেরও সেসব বীজ দিব।’

পর্যাক্রমে গুচ্ছ গ্রামের চারপাশে একটি দুর্যোগ সহনশীল বেষ্টুনি তৈরি করা হচ্ছে ও খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ, আয়বৃদ্ধিমুলক কাজে যুক্ত করার জন্য নারী ও পুরুষকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।

happy wheels 2

Comments