সমাজ শুদ্ধির লড়াইয়ে নেমেছেন বাউল শিল্পী কল্পনা

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
পৌষের শুরুতে কনকনে ঠান্ডা পড়েছে অধিকাংশ গ্রামের বাড়িগুলোতে। সন্ধ্যার সাথে সাথে খেটে খাওয়া পরিশ্রান্ত মানুষগুলো রাতে খাওয়া শেষ করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তেন অন্যদিন হলে। কিন্তু আজ গ্রায়ের চিত্র ভিন্ন একটু আগেভাগে রাতের খাবার শেষ করে তৈরি হচ্ছেন। কারণ আজ গ্রামের বড় বাড়ির উঠানে বাউল গানের আসর বসবে। যাদের বাড়িতে বাউল গানের আসরের আয়োজন করা হয় তাঁরা অবশ্য একটু বেশি ব্যস্ত কারণ বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা বাউল দলটির খাওয়া দাওয়া সব দায়িত্ব তাদের বাড়িতে হবে।
শীতের কুয়াশাকে উপেক্ষা করে একসময় বাড়ির উঠানটি বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা লোকজনে ভিড় হলো। জাত, ধর্ম, বর্ণ ভুলে সবাই মাটিতে বিছানো চটের উপর বসে যান চাদর মুড়ি দিয়ে। উঠানের এক কোনায় ছোট চৌকি কাপড় দিয়ে মঞ্চ করা হয়েছে। শুরু হয় আসর একতারার টুং টুং শব্দ। সাথে নিপুন হাতে হারমোনিয়াম, তবলার সুর! নির্জনতা যেন নিমিষেই উধাও! উপস্থিত সকল মানুষই সুরের মুর্ছনায় উপবিষ্ট! শুরু হয় বাউলদের পালা করে গান গাওয়া, গানের প্রতিটি কথা যেন উপস্থিত মানুষগুলোর হৃদয় থেকে এক একটি শব্দ নিয়ে সাজানো। তাই গান শুনতে শুনতে কখন যে রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো জলে উঠে তারা বিন্দুমাত্র টেরই পাননি!


বাংলাদেশে গ্রামবাংলা বাউল গানের আসরগুলো চিত্র অনেকটা এ রকমই ছিল। ধান কাটা শেষ হলে গ্রামে গ্রামে জমে উঠতো বাউল, জারি গানের আসর। বাংলাদেশের প্রতিটি ফসের একটি বৈচিত্র্য রয়েছে। বিশেষ করে এদেশে শত রকমের ধান চাষ হতো। প্রতিটি ধানের সাথে ছিল বৈচিত্র্যর গল্প। ধানের বৈচিত্র্যের মতো ধানের সাথে জড়িয়ে এদেশের মানুষের জীবনবৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে। সেই চিত্র অনেক বদলেছে, গ্রাম বাংলার মাটির গন্ধ মাখা গানের সুরে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। বাংলাদেশের শত শত বাউল গান লিখিত আকারে সংরক্ষণ না করায় মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে বাংলার পথেঘাটে। অনেক গান হারিয়ে যাচ্ছে! কোথায় আবার সুর ও কথা বদলে নতুন আধুনিক গান হিসেবে রূপ নিচ্ছে। এতে করে গানে সঠিক তাৎপর্য হারাচ্ছে। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। গানকে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতি মানুষের আন্তরিকতা, শ্রদ্ধাবোধ তৈরির বন্ধনগুলো কমে যাচ্ছে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। এতকিছুর পরও আজও বাউল গান বাংলার গান, লক্ষ মানুষের প্রাণের গান!


আমার গান সম্পর্কে অভিজ্ঞতার বা জানার ভান্ডারটি এত কম যে আমি এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা বা বাউল গানের মতো বিষয়ে লিখতে যাওয়া একটি দুঃসাহসী কাজ বলে মনে করি। তাই যাকে নিয়ে আজকের লেখা কথা, যার হাতের হারমোনিয়ামের সুর, যার গলায় বাউল গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যায় সামনে বসা শত শত খেটে খাওয়া মানুষ নেত্রকোনা জেলা সিংহের বাংলা ইউনিয়নে কান্দুলিয়া গ্রামের মেয়ে সেই কল্পনা আক্তারের কথা সবার সাথে আলোচনা করি।

খুব সাধারণ জেলে পরিবারে জন্ম কল্পনা। তার বাবা আব্দুল জলিল সারাদিন মাছ ধরে বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। কল্পনার পরিবারের কেউ গানের সাথে জড়িত নয়। তার মামা সিরাজ মিয়ার বাড়ি তাদের পাশেই। তাঁর মামা একজন সাধারণ বাউল শিল্পী। নিজে শখের বশে সময় পেলে বাড়িতে বসে গান গান। অবশ্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট আসরে গান পরিবেশন করেন তিনি। তার মামা যখন গান পরিবেশন করেন বাড়ির উঠানে বসে কল্পনা সেই গান শুনে তার ভেতরে গানের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তাই মাত্র সাত বছর বয়সে মামার সাথে গান গাইতে শুরু করে। কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই মামার মুখে মুখে শুনে বাউল গান মুখস্ত করে ফেলতো কল্পনা।
সিংহের বাংলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথমবার স্কুলের অনুষ্ঠানে গান গায় কল্পনা। চিপচিপে রোগা ছোট শিশুটির কন্ঠে বাউল গান শুনে মুগ্ধ হয় সবাই।

পরের দিন স্কুলে যাওয়ার পর স্কুলের সংস্কৃতমনা শিক্ষক আছলাম মিয়া তাকে ডেকে নিয়ে গান কার কাছে শিখছে জানতে চান। কোন শিক্ষক ছাড়া এত নিখুঁত বাউল গান শেখার কথা শুনে অবাক হন তিনি। তিনি কল্পনাকে নেত্রকোনা শিল্পকলায় গান শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। সেখান থেকে প্রথমবার গানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কল্পনার। এরপর মামার সাথে পরিচিত বাউল শিল্পী শরীফ সরকারের সাথে নেত্রকোনার আনাচে কানাছে বাউল গানের আসরে গান পরিবেশন করে কল্পনা। খুব অল্প সময়ে বাউল গান পাগল মানুষের মাঝে কল্পনার নাম ছড়িয়ে যায় এবং একসময় রাত জেগে গান গেয়ে কিছু পারিশ্রমিক পেতে থাকে। নিজেই কিছু টাকা সঞ্চয় করে একটি হারমোনিয়াম কিনে সাত হাজার টাকা দিয়ে। সেই হারমোনিয়াম নিয়ে নিজের ভাঙ্গা টিনের ঘরে রাতের পর রাত জেগে গান চর্চা করতো একা একা।


বাউল গান হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধকদের গান। বাউল গানে আত্মাকে মূল বিষয় মনে করা হয়ে থাকে। বাউল শিল্পীরা মনে করে আত্মাকে জানলে পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যাবে। আত্মা দেহে বাস করে। তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করে। বাউল দর্শন সম্পর্কে কল্পনার জ্ঞান সীমিত হলেও নেত্রকোনা বিভিন্ন বাউলদের সাথে আসরে বসে বাউল দর্শন সম্পর্কে যতই জেনেছে বাউল গানকে ততই নিজের আত্মার সাথে মিলাতে শুরু করে।
মহান বাউলদের আদর্শকে নিজের মাঝে ধারণ করে আত্মশুদ্ধির গান দিয়ে সমাজ শুদ্ধ করার যাত্রা শুরু করে কিশোরী কল্পনা। তবে এ কাজ করতে গিয়ে সমাজের নিন্দুকের মুখে পড়তে হয় তাকে। ভালো গায় সেটা বলার আগে সমাজে আর দশটা মেয়ের মতো সে একটা ‘মেয়ে মানুষ’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে। রাত জেগে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গানে আসর যাওয়ার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখলোনা সমাজ। দরিদ্র জেলে পরিবারে মেয়ে এ গান গাওয়া সমাজে একটি অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। তবে সমাজের এ সমালোচনা কল্পনাকে লক্ষ থেকে না সরাতে পারলেও বাদ সাধে তার দরিদ্র মা বাবা। সমাজের চাপের মুখে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে মাত্র ১৪ বছর বয়সে। বাল্য বিয়ের শিকার হয় সে।


এভাবে থেমে যায় সবকিছু! নিজের সকল স্বপ্ন, লক্ষ্যকে দুরে ফেলে কল্পনা শুরু করে সংসার। তবে বিয়ের দেড় বছরের মাথায় স্বামী ও শ্বশুর-শ্বাশুরির অত্যাচারে ফিরে আসে বাবার বাড়ি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়। কিছুদিনের মধ্যেই কল্পনা এক মেয়ের মা হয়ে যায়। তার বাবার মাছ ধরার ব্যবসাও আগের মতো ভালো নেই। কারণ প্রতিবছর নদীতে মাছ কমছে। বাধ্য হয়ে কল্পনা সংসারের হাল ধরেন। ছোট মেয়েকে কুলে নিয়ে হারমোনিয়ামে নতুন করে সুর তুলেন! যোগাযোগ করতে থাকে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে, গানের আসর আবার শুরু করে। এ যেন নতুন কল্পনা, হাসি কমেছে ঠোঁটে কিন্তু গলায় যেন সুরের সাথে কষ্ট জড়িয়ে আরও সুমধুর করে তুলেছে।


বাউল গানে এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ গানে এক ধরনে উদাসী ভাব থাকে। এর সুরে সব সময় এক ধরনের ‘না পাওয়ার’ বেদনা জড়িত থাকে। জীবনের শুরুতে একটি আঘাত কল্পনার গলায় সেই উদাসীনতা এনে দেয়। বাউল গানের আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গানে রাগ বা অভিমান শব্দটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। গানের সাথে জড়িয়ে আছে সকল জীবের প্রতি ভালোবাসা বা মানবের ভালোবাসার মাঝে ঈশ্বরকে খোঁজার!
২১ বছরের কল্পনা এখন জীবন সংগ্রামের হার না মানা এক অগ্রযাত্রী! বাউল গানকে কেন্দ্র সমাজ পরিবর্তনে যে সংগঠনগুলো কাজ করে তাদের সাথে কাজ করেন। কল্পনা তাই জড়িত হয়েছে নেত্রকোনা সিংহের বাংলা আদি সাস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। এই সংগঠনের সাথে কাজ করে কল্পনা বর্তমানে এলাকার সামাজিক নানা সমস্যা তথা বাল্য বিয়ে বন্ধ, নারী নির্যাতন বন্ধ, নারী অধিকার আদায়, প্রবীণ অধিকার আদায়, নবীন প্রবীণের সম্পর্কে উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। গান গেয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই সংগঠনের সাথে সহযোগি সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বারসিকও।
করোনার কারণে দীর্ঘদিন জনসমাবেশ বন্ধ থাকায় কল্পনা বর্তমানে এক ধরনের আর্থিক সংকটের দিন কাটাছে। কল্পনার মতো আমাদের সমাজে অনেক বাউল বা সাংস্কৃতিক কর্মীদের অবস্থাও খুব ভালো নেই। সরকারিভাবে নেত্রকোনায় তালিকাভুক্ত কিছু বাউল শিল্পীকে সহায়তা প্রদান করা হলেও এখনো অনেক বাউল শিল্পী কোন ধরনের সহায়তা পান না।
কল্পনা তার সুর দিয়ে রাতের পর রাত জেগে গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে হাজার মানুষের মনে জায়গা করে নিলেও এখনো তার গানের কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। নেত্রকোনা কৃতী বাউল শিল্পী উকিল মুন্সি, রশীদ উদ্দীন, জালাল উদ্দিন, আব্দুল মজিদ তালুকদার, আব্দুল কুদ্দুছ বয়াতী, আব্দুল সাত্তার, দ্বীন শরত, মিরাজ আলী, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আব্দুল সালাম সরকার, আলেয়া বেগমের মতো কল্পনার নাম একজন বাউল হিসেবে স্থান পেতে হলে প্রয়োজন আমাদের সমাজের দৃষ্টির পরিবর্তন, প্রয়োজন একটু সহানুভূতি। তা হলেই হয়তো কল্পনার মতো পথেপ্রান্তে পরে থাকা বাউল শিল্পীর নাম নেত্রকোনা তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর একজন গুনি বাউলের নাম হিসেবে যুক্ত হতে পারে ।

happy wheels 2

Comments